চাকরি করে যারা বড়লোক হয়েছে -Those who have done the job have grown up


  

এতদিন ধরে শুধু কে কীভাবে ব্যাবসা করে বড়লোক হয়েছে সেটাই তো শুনিয়ে গেলে ভাই। কেউ কি চাকরি বাকরি করত না?’

জানি আমাকে সামনে পেলে আপনারা এই কথা গুলই আমাক বলতেন। কি করব বলুন তখন বেশিরভাগ লোকে চাষ করত নয়তো ব্যাবসা করত। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় ঘাটি গেঁড়ে বসার পরে বেশ কিছু চাকরির সৃষ্টি হয়েছিল বটে। আর সেই চাকরি করে বেশ অনেকেই ধনী হয়েছিলেন। তাহলে আসুন আজকে ব্যাবসা ছেড়ে কিছু চাকরিজীবী বিখ্যাত মানুষের কথা শোনা যাক।
সেইসময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসাবে প্রথমেই যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন ভেরেলস্ট সাহেবের দেওয়ান ও ঘোষাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোকুল ঘোষালের পুত্র ভুকৈলাসের মহারাজা জয়নারায়ন ঘোষাল(১৭৫২-১৮২০)। কোম্পানির অধীনে চাকরি করলেও কলকাতার ব্রাহ্মণ সমাজে জয়নারায়ন ঘোষালের প্রতিপত্তি ছিল প্রচুর এবং কলকাতার ব্রাহ্মণরা তাঁকে তাদের কুলপতি বলে মনে করতেন। এই প্রতিপত্তির প্রকাশ পায় কলকাতার অতি ধনী লোক চূড়ামণি দত্তের শ্রাদ্ধের সময়ে। কথিত আছে যে চূড়ামণি দত্তের পুত্র কালিপ্রসাদের একজন যবনী রক্ষিতা ছিল এবং এই যবনী দোষের জন্য শোভাবাজার রাজবাড়ির ব্রাহ্মণ বর্গ সমস্ত ব্রাহ্মণ সমাজকে নির্দেশ দেন যে ‘কোন ব্রাহ্মণ যেন এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগদান না করেন’। এর ফলে শ্রাদ্ধ পণ্ড হয়ে যেতে বসলে কালিপ্রসাদের অনুরোধে জয়নারায়ন ঘোষাল সকল ব্রাহ্মনকে যোগদান করেত বলেন।

কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে মতবিরোধ আছে একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরির পরিবার এবং সন্তোষ রায়ের মধ্যস্থতায় ব্রাহ্মণরা শ্রাদ্ধে যোগদান করেন কিন্তু কোন দক্ষিণা তাঁরা গ্রহন করেননি। ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা বাবদ ২০০০০ টাকা কালিপ্রসাদ দত্ত সন্তোষ রায়ের হাতে তুলে দান যা দিয়েই পরবর্তীতে কালীঘাটের বর্তমান মন্দির তৈরি হয়।

এছাড়াও জয়নারায়ন ঘোষাল কলকাতার শিক্ষা ব্যাবস্থা বিকাশে বিশেষ স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজ বাসভবনে একটি ইংরাজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এবং তাকেই দেশের ইংরাজি শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ বলাহয়। তিনি নিজে অনেক বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য রচনা করেছিলেন এবং কাশির রাজাকে মহাভারতের হিন্দি অনুবাদে সাহজ্য করেছিলেন।

ভুকৈলাসের মহারাজা জয়নারায়ন ঘোষাল-এর পর যার কথা আসে তিনি হলেন বাগবাজারের দুর্গাচরন মুখোপাধ্যায় যার নামে দুর্গাচরন মুখোপাধ্যায় স্ট্রীটের নামকরন হয়েছে। দুর্গাচরন মুখোপাধ্যায় একসাথে তিন মানুষের দেওয়ানি করেছেন। রাজশাহির কালেক্টর রুশ সাহেব, মিন্টমাস্টার হ্যারিস সাহেব, এবং আফিমের এজেন্ট হ্যারিসন সাহেব। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে তিনজনের দেওয়ানি করে মুখার্জি মহাশয় বেশ অনেক পরিমাণই অর্থ উপার্জন করেছিলেন। পংক্ষির আড্ডার নাম শুনেছেন? এই পংক্ষির আড্ডা আসলে গাঁজা খাবার আড্ডা। এই আড্ডার প্রচলন দুর্গাচরন মুখোপাধ্যায় মুখোপাধ্যায় করেছিলেন বলে মনে করাহয় কিন্তু অনেকে আবার বলেন এই আড্ডা দুর্গাচরন মুখোপাধ্যায়-এর ছেলে শিবচন্দ্র শুরু করেছিলেন। কিন্তু এখানে বলে রাখি “রসগোল্লা” সিনেমায় যে রূপচাঁদ পংক্ষির দলের কথা শুনেছেন না? ওটার সাথে এটাকে গোলাবেননা। রূপচাঁদ পংক্ষির দল গানের দল। আর দশটা লোক যেটা করে আপনি কেন সেটা করবেন?

এর পর যার কথা বলতে হয় তিনি হলেন দেওয়ান হরি ঘোষ। “হরি ঘোষের গোয়াল” প্রবাদটা শুনেছেন তো? দুই হরি ঘোষ কিন্তু একই।তৎকালীন সময়ে ইংরাজি এবং ফারসী ভাষা লিখতে এবং বলতে জানতেন বলে তাঁর কদর এবং বেতন দুটোই বেশ বেশি ছিল। তিনি তাঁর কর্ম জীবন শুরু অতিবাহিত করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান হিসাবে। দেওয়ানী থেকে অবসর গ্রহন করার পর তিনি কলকাতায় এসে নিজের বসতবাড়ি প্রস্তুত করেন। কলকাতার বাইরে থেকে কলকাতায় পড়তে আসা অনেক ছাত্র তাঁর বাড়িতে থাকা এবং খাওয়ার সুবিধা পেত। কিন্তু হঠাৎ “হরি ঘোষের গোয়াল” এই কথাটা এল কেন? আসলে হরি ঘোষের বাড়িতে বড় একটি বৈঠক খানা ছিল আর তাতে তজ খোশ গল্পের আসর বসত। অনেক নিষ্কর্মা লোক এই বৈঠক খানাতে এসে গল্পে মজে থাকত তাই এই নামের উদ্ভব। বর্তমান গ্রে স্ট্রীট থকে বীডন স্ট্রীট পর্যন্ত রাস্তা তাঁর নামেই নামাঙ্কিত,’হরি ঘোষ স্ট্রীট।’

তৎকালীন কলকাতায় আরও বেশ কয়েকজন দেওয়ানী করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন

শান্তিরাম সিংহ, যিনি জোড়াসাঁকো সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা।

রামহরি বিশ্বাস যিনি নিমক মহলের এজেন্ট  হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান।

রামসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পাটনার আফিমের এজেন্টের দেওয়ান।

কৃষ্ণরাম বসু ছিলেন কোম্পানির হুগলী জেলার মূল লবন এজেন্টের দেওয়ান এবং শ্যামবাজারের বসু পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নামেই নামাঙ্কিত শ্যামবাজারের কৃষ্ণরাম বসু স্ট্রীট। তাঁর পৌত্র নবীনচন্দ্র বসুর বাসগৃহ ছিল বর্তমান শ্যামবাজার ত্রাম ডিপোর জমিতে। এই নবীনচন্দ্র বসু তাঁর গৃহপ্রাঙ্গনে প্রথম প্রথম নাট্যশালা স্থাপন করেন এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ই সেপ্টেম্বর তাঁর বাড়িতেই “বিদ্যাসুন্দর” অভিনীত হয়। ট্রাম ডিপোর পিছনে যে শিব মন্দিরটি আছে সেটি নবীনচন্দ্র বসুরই তৈরি।

আরও একজন দেওয়ান যিনি বাংলার ইতিহাসে স্মরনিয় হয়ে আছেন তিনি হলেন দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। তৎকালীন সময়ে কলকাতায় ব্রিটিশ আমলাদের মধ্যে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এদেশের জনসাধারণের মধ্যে ইংরাজি শিক্ষার একজন অন্যতম পথিকৃৎ। হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনিও একজন অন্যতম সদস্য। 
  
এইখানেই শেষ হল এই ‘পুরনো কলকাতার বাঙালি বড়লোক’ সিরিজ। আসব খুব তাড়াতাড়ি ‘পুরনো কলকাতার ব্যাবসা-বাণিজ্য’ সিরিজ নিয়ে।  

0 Comments:

Post a Comment