কলকাতায় বাঙালির ব্যবসাঃ পর্বঃ ১ (Bengali Businessman in Calcutta: Episode:1)

 


ব্রিটিশদের ব্যবসা চুক্তি এবং জাত ব্যবস্থার বিলোপঃ

কলকাতায় প্রথম এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ এবং তার পরবর্তীতে অনেক ছোট ব্যবসাদাররা কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। এবং এই সময় থেকেই কলকাতায় বিদেশী জাতি ব্যাবসা করতে থাকে। এই সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলেছি সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলিকাতার নামকরণ ও বাণিজ্যের ইতিহাস এই ব্লগে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে জাত ব্যাবস্থা বলতে কি আমি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় প্রভৃতি জাতের কথা বলছি? না। আসলে এখানে জাত ব্যাবস্থা হল ব্যবসায়িক জাত ব্যাবস্থা। কে কি ব্যবসা করছে তার ওপর ভিত্তি করে জাত প্রথা এবং সম্পূর্ণটাই মানুষের মন গড়া।

যেমন কলকাতার সনাতন পরিবার বা ব্যবসাদারদের কথা যদি বলতে হয় তাহলে সবার আগেই উঠে আসে সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ- দের কথা কারণ কলকাতায় বিদেশী ব্যবসাদার আসার আগেথেকে এনারা ব্যবসা করছেন। মূলত সুতোর ব্যবসা ছিল বলে এনাদের বলাহয় তন্তুবায় সম্প্রদায়। আবার বিদেশী ব্যবসাদাররা আসার সাথে সাথে অনেক ব্যাবসাদার রা কলকাতায় চলে আসেন যেমন যারা সোনার ব্যবসা করত তাঁরা পরিচিত হন স্বর্ণ বনিক হিসাবে, কাঁসার ব্যবসা যারা করত তাঁরা কংসবণিক হিসাবে। আবার মাটির মূর্তি গড়ার কাজ যারা করতেন তাঁরা পাল সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত হলেন বাবার তাঁরা যেখানে থাকতেন সেখানকার নাম হল কুমোরটুলি। এরম ভাবে অনেক সম্প্রদায় কলকাতায় এসেছে এবং বিভিন্ন স্থানের নাম হয়েছে যেমন দর্জি পাড়া, আহিরিটোলা প্রভৃতি। সাধারনত স্বর্ণবনিক, কংসবণিক, তন্তুবায় এরা কুমোর, কামার , দর্জি প্রভৃতি সম্প্রদায়কে নিচু চখে দেখত। কিন্তু ইংরেজরা কলকাতায় বাণিজ্য করার অধিকার পাওয়ার পরে প্রথমেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ দের সাথে ব্যবসা চুক্তি করেন শুধু এখানেই থেমে তাকেননি নিজেদের প্রয়োজনে এবং লাভের জন্য পায় সন সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্যবসা চুক্তি করেন এবং দাদন* দেন। এই ঘটনা যে সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ ভাল ভাবে নেয়নি সেটা আপত্তি জনিয়েই বুজিয়ে দেন শুধু তাই নয় তাঁরা কোম্পানির কাছ থেকে যে দাদন নেবেন না তাও বলেন। ভবিষ্যতে যে বাঙালি নিজেদের কৌলীন্য বৃত্তি হারিয়ে ফেলার যে প্রবনতা দেখতে পেয়েছিল টা এই ঘটনা থেকেই বুজতে পারি।

কোম্পানি কলকাতায় যে সময়ে লাইসেন্সে প্রথা আনে সেই সময় যে বাঙালি কৌলীন্য বৃত্তি হারাচ্ছিল তা বুঝতে পারি কারণ এই এইসময়ে কোম্পানি বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন কারবার করার লাইসান্সে দিয়েছিল।প্রথম ১৭৩৮ সালে ইংরাজ কোম্পানি গ্লাস তৈরি, আতশবাজি তৈরি, নারকেল দড়ির কারখানা করার জন্য লাইসেন্সে প্রদান করেছিলেন। আবার ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ ঘোষ লাইসেন্সে নিয়েছিল আয়নার কারখানার জন্য, মনোহর মুখোপাধ্যায় লাইসেন্সে নিয়েছিল নৌকা ও বোটের কারবারের জন্য, আতসবাজির জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন ময়নদ্দি বারুদওয়ালা, সিন্দুর প্রস্তুতির জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন নারায়ন সামন্ত, মেটে সিন্দুর এবং হিরাকস প্রস্তুতির জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন ফকির চাঁদ দত্ত, গাঁজা ও সিদ্ধির দোকানের জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন বাবুরাম ঘোষ।

১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে যারা লাইসেন্সে নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, আয়নার কারখানার জন্য বাবুরাম ঘোষ,  মেটে সিন্দুর,হিরাক্‌তুতে এবং ফটকিরির -এর জন্য জগন্নাথ হালদার,আতসবাজির জন্য কালিচরন সিংহ, সিদ্ধির দোকানের জন্য  আনন্দরাম বিশ্বাস।

এতক্ষণ যা বললাম তাতে এটা বোঝাগেলো যে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় সমস্ত রকম বাঙালি সবরকম ব্যবসায় নিজেদের নিয়োজিত করে। এই সময়ের অনেক বাঙালি ইংরেজদের সাথে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করে বিশেষ ধনপতি হয়েছিলেন। তাদের সকলের কথা প্রায় “কলকাতার বাঙালি বড়লোক” এই সিরিজ-এ বলেছি। তবুও এখানে তাদের নাম গুলো জেনে নেওয়া যাক। তন্তুবায় গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বৈষ্ণবচরন শেঠ, তাম্বুলি গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গোবর্ধন রক্ষিত, সুবর্ণ বনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সুখময় রায়, মথুরামোহন সেন, প্রাণকৃষ্ণ লাহা, লক্ষ্মীকান্ত ধর, মতিলাল শীল, সাগর দত্ত প্রমুখ। কায়স্থ হয়েও যারা ব্যবসাতে অংশগ্রহণ করেছিলে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন গোকুল দত্ত, মদন দত্ত, রামদুলাল সরকার।চিন্তা নেই ব্রাহ্মণের সাথেও পরিচয় হবে।  

সামনের পর্ব থেকে বিভিন্ন বাঙালির ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা কর। কথা দিছি ভাল লাগবে। একটু অপেক্ষা করুন।

·        দাদন কি?

দাদন কথাটি এসেছে ফরাসি দাদনি কথা থেকে, যার অর্থ হল অগ্রিম। ইংরেজরা ভারতীয়দের সাথে ব্যবসায়িক চুক্তি করে তাদের অগ্রিম প্রদান প্রথা চালু করেন। একেই বলে দাদন প্রথা। অনেকটা আজকের advance দেওয়ার মতো।

0 Comments:

Post a Comment