আর্মেনিয়ান চার্চ এবং কলকাতার সবথেকে পুরনো সমাধি -The Armenian Church and the oldest tomb in Kolkata
সাধারন ভাবে আমরা জেনে আসছি
১৬৯০ সালে জব চারনক কলকাতায় পদার্পণ করে এবং কলকাতার সূচনা। আমি আমার প্রথম দুটি ব্লগে
প্রমান করেছি যে ব্রিটিশ আসার আগে কলকাতার অস্তিত্ত ছিল জাকে নতুন রুপ দিয়েছিল ইংরেজরা।
কিন্তু কলকাতায় প্রথম কোন বিদেশী শক্তি এসেছিল? ব্রিটিশ নাকি আর্মেনীয়? এই প্রশ্নের
উত্তর আর্মেনীয়। কিন্তু কিভাবে?
কলকাতার হাওড়া ব্রিজের নিকটে
আর্মেনীয় স্ট্রিট এবং আর্মেনীয় চার্চ এই কথা প্রমান করে যে কলকাতায় আর্মেনীয়রা এসেছিলেন।
সেটা ব্রিটিশ দের আগে নাকি পরে সেটা বুঝতে গেলে এই চার্চ-এর ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে
হবে।
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি
সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ইউরোপ নিবাসী আর্মেনিয়ানদের মধ্যে একটি চুক্তি
হয় যার বিষয়বস্তু ছিল যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন স্থানে আর্মেনিয়ানদের
জন্য গির্জা তৈরি করে দেবে। এই চুক্তি সাক্ষর করেন কম্পানির পক্ষ থেকে Sir Josia
Child এবং আর্মেনিয়ান দের পক্ষ থেকে Khoja Sarhad এবং Khoja Phanoosh। এই চুক্তির ভিত্তিতেই
১৬৮৮ সালে বর্তমান গির্জার দক্ষিণপূর্ব শাখায় কাঠের তৈরি গির্জার প্রতিষ্ঠা হয়। শুধু
তাই নয় সেই গির্জায় ৪০ জন আর্মেনীয়দের বসবাসের ব্যাবস্থা করেন এবং যেসব পুরোহিত নিয়োগ
করা হত তাদের ৫০ পাউন্ড করে মাসিক পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাবস্থাও ছিল। কিন্তু একটি ভয়াবহ
অগ্নিকান্ডে পুরনো গির্জাটি পুড়ে গেলে ১৭৩৪ সালে Aga Mamed Hazaar Maliyar নামক একজন
আর্মেনীয় ১৭৩৪ সালে গির্জার বর্তমান ভাবনটি তৈরি করেন। যেখান ব্রিটিশদের দারা কলকাতায়
প্রথম গির্জা তৈরি হয় St. John's Church, ১৭৮৭ সালে । এবং কলকাতায় আর্মেনিয়ানদের অনেক আগের থেকেই উপস্থিতির
জোরালো প্রমান হল আর্মেনিয়ান চার্চ- এর কবরস্থানে আর্মেনীয় ব্যক্তি সুখিয়া সাহেবের
স্ত্রি Rezabeebeh –এর কবর, যার মৃত্যু হয় ১৬৩০ সালের ২১শে জুলাই।
কিন্তু আর্মেনিয়ানরা কি ব্রিটিশদের
কলকাতায় আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছিল? এই উত্তর খুজতে গিয়ে একজন আর্মেনীয় ঐতিহাসিক
(নাম আমার অজানা) কলকাতা এবং লন্ডনে ব্রিটিশদের ঐতিহাসিক দলিল খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার
করেন বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য, যেমন- কলকাতায় তিনটি জনপদ(কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর)-এর
মালিকানা থেকে ১৭১৭ এর ফারুকশিয়ারের ফরমান এবং পলাশির যুদ্ধের ষড়যন্ত্র সবেতেই সক্রিয়
হাত ছিল আর্মেনিয়ানদের। আসুন এবার শুনি সেই অজানা ইতিহাস।
ফারুখশিয়ারের ফরমান এবং পলাশির যুদ্ধে আর্মেনিয়ানদের ভুমিকাঃ
সাল ১৬৯০, কলকাতার মাটিতে
পা রাখলেন জব চারনক, উদ্দেশ্য দেশের পূর্ব অংশে কম্পানির ব্যবসার বিস্তার লাভ। কিন্তু
প্রথম থেকেই বাধা। অনেক আগেথকেই এখানে ব্যবসা করছে পর্তুগীজরা। সেই সাথে দিল্লির নবাবের
অনুমতি নেই এখানে ব্যবসা করার। অনুমতি যদিও পাওয়া যায় মুল সমস্যা হবে ব্যবসসার জন্য
দুর্গ, ফ্যাক্টরি, গুদাম তৈরি করতে। তখন আবার বাংলার মসনদে বসে আছেন তিব্র ইংরেজ বিরিধী
জবরদস্ত খাঁ। এই সব সমস্যার মধ্যে কেতে যায় প্রায় ৬ বছর। ১৬৯৬ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে
বিদ্রহ শুরু করলেন শোভা সিং। ভাবা হল এই বিদ্রহ দমন করে হয়ত ইংরাজদের কিছু সাহায্য
করবেন জবরদস্ত খাঁ, কিন্তু তিনি ইংরেজ বিরোধিতা
বজায় রাখলেন।
এখন উপায় না দেখে কোম্পানি
এমন লোক খোঁজা শুরু করল যে জবরদস্ত খাঁ এর কাছে ইংরেজদের দাবি পেশ করতে পারবে। পাওয়াও
গেল একজন আর্মেনিয়ান ব্যক্তি নাম খোজা ইসরায়েল সারহেদ যিনি হুগলী- এর একজন বিখ্যাত
ব্যবসায়ী এবং গুজরাতের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ফানুস কালান্দারের ভাতুস্পুত্র। এবং সবথেকে
আকর্ষণীয় বিষয় হল আর্মেনিয়ানরা ইউরোপ থেকে স্থল পথে আফগানিস্থান এবং পারস্য হয়ে প্রথম
ব্যবসা করতে আসে আকবরের সময়ে। সেই থেকে এই বংশের সাথে মুঘল বংশের সুসম্পর্ক আকবরের
সময় থেকেই ফলে মুঘল বাদশ-এর অনুমতি পাওয়া খুব
কঠিন হবেনা। এরই মাঝে সাপে বর হল। ১৬৯৭ সালে ঔরঙ্গজেব-এর নাতি আজিম ওসমান এলেন বাংলার
সুবেদার হয়ে। আনুমতি চাওয়া হল তার দরবারে যাওয়ার। অনুমতি এল। সারহেদ এর নেতৃত্বে কোম্পানির
কর্মকর্তারা গেলেন সঙ্গে অনেক উপঢৌকন। কাজ হল ,আর্মেনিয়ানদের মুঘল পরিবারে পরিচিতি কাজে আসল। অনুমতি পাওয়া গেল,
চাইলে কোম্পানি কলিকাতা, সুতানুটি এবং গোবিন্দপুর কিনে নিতে পারবেন এবং নির্দিষ্ট বার্ষিক
খাজনায় ব্যবসা এবং দুর্গ, ফ্যাক্টরি, গুদাম এবং জনবসতি সবই স্থাপন করতে পারবে। এই চুক্তির
অপর ভিত্তি করে ১০ই নভেম্বর ১৬৯৮ সালে ১৩০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রিহয়ে গেল এই তিনটি গ্রাম
এবং বার্ষিক খাজনা ঠিক হল ১১৯৫ টাকা। পত্তন হল কলকাতা নগরীর। এত কিছু কি হত যদি আর্মেনিয়ানরা
না থাকত?
কিন্তু বিপদ পিছু ছাড়েনি ইংরেজদের।
বাংলার নবাব জাফর খাঁ ক্রমাগত তাদের অধিকার খর্ব করতে থাকে। বাতিল করতে থাকে ইংরেজদের
সমস্ত অধিকার। এবার উপায়? ঠিক হল দিল্লির সম্রাটের দরবারে আবেদন জানাতে হবে ব্যবসার
জন্য। এখানেও সাহায্যে এগিয়ে আর্মেনিয়ান ব্যক্তি খোজা ইসরায়েল সারহেদ। তখন দিল্লির
সিংহাসনে ফারুকশিয়ার আর এই খোজা ইসরায়েল সারহেদ তারই বাল্যবন্ধু। সেই সাথে খোজা ইসরায়েল
সারহেদ এদেশীয় ভাষা জানেন ভাল করে ফলে সম্রাটকে দাবি জানাতে কোন অসুবিধাই হবেনা। কিন্তু
ভয় একটাই যদি রাস্তায় বিপদ হয়। সে ব্যাবস্থাও হল, সেখানেও আর্মেনিয়ান সহায়। খোজা মানুর
যিনি ঔরঙ্গজেবের দুহিতা বাদিসাহা বেগম এর অনুচর, তিনি খবর পাঠালেন যে পথে কোন বিপদের
ভয় নেই।
এবার দূত বাহিনী গঠনের পালা,
কোম্পানি প্রধান হিসাবে থাকলেন জন সারমান, মুল দাবি পেশকারী এবং দোভাষী হিসাবে থাকলেন
খোজা ইসরায়েল সারহেদ এবং বাকি দুজন সদস্য হলেন জন প্রেট এবং এডওয়ার্ড স্টিফেন। অবশেষে
১৭১৭ সালে ফহারুক শিয়ার ফরমান জারি করলেন এবং ইংরেজদের অধিকার দিলেন বাংলা, বিহার ও
উড়িষ্যায় বাণিজ্য এবং কুঠি তৈরি করার। সেই সাথে হুগলী নদীর দুপাশে ১০মাইল অবধি ৩৮টি
গ্রাম কেনার অধিকার পায়। যার ফলে প্রায় পুরো ২৪ পরগনা ইংরেজদের হাতে থাকে। এবং একটি
হুকুম নামার মাধ্যমে সম্রাট সকল সুবেদার এবং নবাব কে এই ফরমান মানার আদেশ দেন।
হাফ ছেড়ে বাঁচে কলকাতা বাসি
কারন মুঘল আমলের কোন পরাধীনতাই আর নেই এই ইংরেজ রাজত্বে। ফলে ইংরাজদের সাথে ব্যবসা
করে ক্রমেই ধনবান হতে থাকে বাংলার বনিক বাহিনী। কিন্তু সেই সময়ে এই দূত বাহিনীকেই কোন
মূল্য দেইনি ব্রিটেন। তার বদলে সম্পূর্ণ সাফল্যের অধিকারী করা হয় ডা. হ্যামিল্টনকে
, এবং দাবি করাহয় তিনি মুঘল সম্রাটের অসুখ নিরাময় করেছিলেন বলে এই ফরমান কোম্পানি পায়।
সেন্ট জন চার্চে হামিল্টনের সমাধিতে আজও এই কথা লেখা আছে।
এরপর আর কোন সমস্যাই হইনি।
বাংলার নবাব-সুবেদারদের সাথে দরবার করে সব সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছিলেন খোজা ইসরায়েল সারহেদ।
ইংরেজদেরও ব্যবসা ঝরের গতিতে এগচ্ছে, বাসস্থান, দুর্গ সব তৈরি হয়েছে, একাধিক বাঙালি
ব্যবসায়ী ক্রমেই ধনী হয়ে উঠছেন, জনবসতি বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু কথায় আছে সুখ বেশীদিন
থাকেনা জীবনে। ফরমানের চার দশকের মথায় ১৭৫৬ সালের জুন মাস, কোম্পানির ব্যবসা মধ্য গগনে
সেই সাথে ঠাণ্ডার দেশের ইংরেজ কলকাতার ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল। এরই মধ্যে ১৬ই জুন ১৭৫৬
সিরাজউদ্দৌল্লা আক্রমন করলেন কলকাতায়। ইংরাজদের শোচনীয়
পরাজয় ঘটলো, সিরাজউদ্দৌল্লা গুড়িয়ে দিলেন ইংরেজদের দুর্গ এবং ঘটলো অতি বিতর্কিত সেই
অন্ধকূপ হত্যা। এবং কলকাতার নাম বদলে হল আলিনগর।
এই ঘটনা
থেকে সহজে উদ্ধারের আশা নেই কারন সেই সময়ের কলকাতায় থাকা কোম্পানি প্রেসিডেন্ট ড্রেক
এবং অন্যান্য কর্তারা কলকাতা আক্রমনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে টকা পয়সা এবং কাগজপত্র
নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে নিজেদের প্রান বাঁচাতে। ফলে যে কয়েকজন ইংরেজ যুদ্ধের পর বেঁচে ছিলন
তাদের ঠিকানা হল ফলতার ইংরেজ রিফিউজি কেন্দ্রতে। সেখানেও খাবার পৌঁছানোতে নিষেধাজ্ঞা
জারি করলান নবাবা।
ঠিক এই সময়েও
পাশে এসে দাঁড়ালেন কলকাতার এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ী খোজা পোট্রাস আরাটন। রাতের অন্ধকারে
খাবার পৌঁছতে শুরু করলেন ইংরেজদের কাছে। কারন কোন উপায় আর খলা নেই। ক্লাইভ এবং ওয়াটসন
তখন জাহাজে ফলে কোন মূল্যবান সিধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই পোট্রাস ক্লাইভ এর
পথ কিছুটা সহজ করে রেখেছিলেন কলকাতার দায়িত্বে থাকা নবাবের কর্মচারী মানিকচাঁদের সাথে
এবং তার মারফত উমিচাঁদ এবং জগত শেঠ এর সাথে। এইভাবে কয়েকমাস চলার পরে কলকাতায় এসে পৌঁছলেন
ক্লাইভ এবং ওয়াটসন, আর শুরু হল মীরজাফরের সিরাজকে সরাবার ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের ফল
সকলের জানা। এর পরে মীরজাফরকে সিনহাসনচুত করা এবং সেইসাথে বক্সারের যুদ্ধে মিরকাশিমকে
হারানো সবেতেই মাথার অপর ছাতা হয়েছিল আর্মেনিয়ান এবং খোজা পোট্রাস আরাটন।
কিন্তু ঐযে
আগেই বলেছি ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর যখন ভারতে ইংরেজদের
পাকাপাকি শাসন তখনি আর্মেনিয়ান দের বিরোধিতা শুরু করল ইংরেজ কোম্পানি। পোট্রাস কে মিথ্যে
মালায় ফাঁসিয়ে শাস্তির দরবার শুরু হয়। মনের দুঃখে পোট্রাস চিঠি লিখলেন কম্পনির ইংল্যান্ড
হউসে, সেই চিঠিতে তিনি লিখলেন “আপনাদের বিপদের সময়ে আমি নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশান্তরে
ছুটে বেড়িয়েছি এবং সর্বোপরি আপনদের বর্তমান সুখকর পরিস্থিতির জন্য আমিই দায়ি কিন্তু
আমার এমনি কপাল যে আপনারা একবারও আমার কথা উল্লেখ করলেন না। ” সেই চিঠির কোন উত্তর আজও আসেনি এবং যানাও যায়নি শেষ
অবধি পোট্রাসের কি হয়েছিল।
অনেক খোঁজাখুঁজির
পর এক আর্মেনীয় গবেষক লন্ডনের এক অন্ধকার ঘর থেকে অতি অজত্নে পড়েথাকা পোট্রাসের এই
চিঠিটি উদ্ধার করেন তাও প্রায় দুই শতাব্দি পরে।
ইতিহাস সত্যিই
নিষ্ঠুর।।
0 Comments:
Post a Comment