বাঙালি ব্যাবসায়ী- বৌবাজারের নামকরণ এবং অন্যান্য:
এতগুলো পর্বে তো
অনেক ব্যাবসায়ীর কথা শুনলেন কিন্তু বলতে খারাপ লাগলেও এনারা সকলেই ইংরেজদের সাথে
ষড়যন্ত্র করে বা ইংরাজদের পিছনে তেল দিয়েই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা বড়লোক
হয়েছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক সময়ে অনেকই ছিলেন যারা নিজেদের পরিশ্রম এবং চেষ্টায়
নিজেদের ধনী হয়েছিলেন। তবে শুধু ব্যাবসা করে নয় অনেকে বেনিয়ানি(দালালি) করেও বড়লোক
হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এনাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
কিন্তু আসুন জেনেনি যেটুকু ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়।
প্রথমেই আসি
রামচন্দ্র মিত্রের কথায়, তিনি কলকাতার একজন বিখ্যাত বেনিয়ান ছিলেন এবং কলকাতা
বন্দরে আসা জাহাজের ক্যাপ্টেনদের বেনিয়েনি করে তিনি বেশ ধনী হয়েছিলেন।
এরপর সেসময়ের
শ্রেষ্ঠ ধনী বলা হত গঙ্গারাম সরকারকে। প্রথম জীবনে তিনি পামার কোম্পানির খাজাঞ্চি
হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে নিজের স্বাধীন ব্যাবসা শুরু করেন এবং
তিনি এত অর্থ উপার্জন করেছিলেন যে সেই সময়ে তাঁকে কলকাতার শ্রেষ্ঠ ধনীদের অন্যতম
বলা হত।
বৌবাজারের মালিকঃ
সোজা ভাবে বলতে গেলে বউবাজারের মালিক বিশ্বনাথ মতিলালের পুত্রবধু। আসুন তাহলে পুরো
কথাটা খুলে বলি। বিশ্বনাথ মতিলাল ছিলেন দুর্গাচরন পিতুরির ভাগ্নে। আর এই দুর্গাচরন
পিতুরি ছিলেন বর্তমান বৌবাজার অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বাজারের মালিক। বিশ্বনাথ মতিলাল
মামার সম্পত্তির কিছু অংশ পান এবং তাতে বেশ কয়েকটি বাজার পান। বিশ্বনাথ মতিলাল
প্রথম জীবনে মাসিক আট টাকা বেতনে একটি লবনের গোলায় চাকরি পান। কিছুকাল পড়ে
ম্যাকিনটন এন্ড কোম্পানি ও ক্রুটেনডেন এন্ড কোম্পানির সাথে জড়িত হয়ে স্বাধীন ভাবে
ব্যাবসা শুরু করেন। বিশ্বনাথ মতিলাল তাঁর মৃত্যু কালে ১৫ লক্ষ টাকার সম্পত্তি এবং
বাজার গুলি রেখে যান। যার মধ্যে একটি বাজারের মালিকানা তাঁর বধুমাতা লাভ করেন। সেই
থকে একমাত্র সেই বাজারটির নাম হয় বৌবাজার। ক্রমে অবশ্য পুরো অঞ্চলের নামই হয়ে যায়
বৌবাজার।
মদনমোহন দত্ত এবং
হাটখোলা রাজবাড়িঃ
অষ্টাদশ শতাব্দীর
শেষের দিকের একজন বিখ্যাত ব্যাবসায়ি ছিলেন মদনমোহন দত্ত। তাঁর প্রপিতামহ
গোবিন্দশরন দত্ত আন্দুল থেকে গোবিন্দপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই গোবিন্দশরন
দত্ত-এর পৌত্র রামচন্দ্র হাটখোলায় উঠে আসেন এবং হাটখোলার দত্ত পরিবারের প্রতিষ্ঠা
করেন। এই রামচন্দ্র দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন মদনমোহন দত্ত।
এই মদনমোহন দত্ত
নিজে স্বাধীন ব্যাবসা করে প্রচুর অর্থের মালিক হন। এই মদনমোহন দত্তের অধীনে
রামদুলাল সরকার এবং তাঁর মাতামহী নিরাশ্রয় হিসাবে আশ্রয় লাভ করেন এবং রামদুলাল
সরকার মদনমোহনের সরকার বা ম্যানেজার নিযুক্ত হন। রামদুলাল সরকার একবার এক ডুবন্ত
জাহাজ থেকে একলক্ষ টাকা লাভ করেন কিন্তু সেই টাকা নিজে না নিয়ে মদনমোহন দত্তকে
দিয়ে দেন। রামদুলাল সরকারের এই সততায় খুশি হয়ে এই একলক্ষ টাকা রামদুলাল সরকারকে
মদনমোহন দত্ত দান করেন।
এই একলক্ষ টাকা
নিয়ে রামদুলাল সরকার স্বাধীন ব্যাবসা শুরু করেন এবং তাঁর হাত ধরেই বাংলার সাথে
আমেরিকার বর্হিবানিজ্যের সূত্রপাত ঘটে। কলকাতার বনিক মহলে তাঁর বিশেষ খ্যাতি হয়
এবং মাতৃ শ্রাদ্ধে তিনি কয়েক লক্ষ টাকা ব্যায় করেন। রামদুলাল সরকারের দুই ছেলে
উনবিংশ শতাব্দির কলকাতার সমাজে ছাতুবাবু এবং লাটুবাবু নামে পরিচিত ছিলেন।
মদনমোহন দত্ত
হাটখোলার পুরনো বাড়িতেই ছিলেন কিন্তু তাঁর খুড়তুত ভাই জগৎরাম দত্ত ১৭৯৪
খ্রিষ্টাব্দে নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে নতুন বাড়ি তৈরি করেছিলেন।জগৎরাম দত্ত-এর
বংশধরেরা আজও নিমতলার বাড়িতে বসবাস করেন। মদনমোহনের পুত্র রামতনু দত্ত তৎকালীন
কলকাতার আটবাবুর ১বাবু ছিলেন এবং গঙ্গার ঘাটে তিনি একটি ঘাটও তৈরি করে দিয়েছিলেন।
সৎ ব্যাবসায়ি
বৈষ্ণবচরন শেঠঃ
অষ্টাদশ শতকে
বড়বাজারের সবথেকে সৎ ব্যাবসায়ি হিসাবে বৈষ্ণবচরন শেঠকেই বিবেচনা করাহয়। তিনি ছিলেন
জনার্দন শেঠের পুত্র। এই বৈষ্ণবচরন শেঠকে নিয়ে অনেক মত প্রচলিত আছে। যেমনঃ
একবার তাঁর অংশিদার
গৌরী সেন কিছু দস্তা কেনেন কিন্তু পরে গৌরি সেন লক্ষ করেন সেই দস্তার মধ্যে কিছু
পরিমান রূপো মিশ্রিত আছে। কিন্তু বৈষ্ণবচরন এটাকে তাঁর অংশীদারেরে অদৃষ্টের লিখন
মনে করেন এবং রুপোর লভ্যাংশ নিতে অস্বীকার করেন যা তাঁর অংশীদারকে রাতারাতি ধনী
হতে সাহায্য করে।
আবার আরেকটি মত
অনুসারে বৈষ্ণবচরন শেঠ ছিলেন পর্তুগীজ আমলের লোক এবং পর্তুগীজ নির্মিত বান্ডেল
চার্চ দেখে তাঁর অনুরূপ হিন্দু মন্দির করার বাসনা জাগে। এবং সেই সময়ে ভৈরবচন্দ্র
দত্ত নামে একজন তাঁকে নৌকা সহযোগে কিছু দস্তা পাঠাচ্ছিলেন এবং সেই দস্তা রূপোতে
রূপান্তরিত হয়ে গেছে বলে তিনি স্বপ্নে আদেশ পান। সেই দৈব লব্ধ অর্থদ্বারাই হুগলীতে
‘গৌরীশঙ্কর মন্দির’ নির্মাণ করাহয়।
আরও একটি ঘটনার কথা
প্রচলিত আছে তাহল, বৈষ্ণবচরন শেঠ একবার বর্ধমানের গোবর্ধন রক্ষিতের কাছ থেকে ১০০০০
মন চিনি কেনার চুক্তি করেন। কিন্তু চিনি কদমতলার ঘাটে এসে পৌঁছালে বৈষ্ণবচরন শেঠের
কর্মচারীরা গোবর্ধন রক্ষিতের কাজথেকে উৎকোচ আদায় করতে না পেরে চিনি নিম্নমানের বলে
প্রচার করেন। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত গোবর্ধন রক্ষিত চিনি নদীর জলে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ
দেন। সমস্ত ঘটনা বৈষ্ণবচরন শেঠের কানে গেলে তিনি অবশিষ্ট চিনি কিনে নেন এবং
ক্ষতিপূরণ বাবদ গোবর্ধন রক্ষিত-কে সম্পূর্ণ চিনির দাম মিটিয়ে দেন।
এরম সততা এরপরে
কলকাতার ব্যাবসায়ি মহলে আর দেখা গেছে বলে আবার ব্যক্তিগিত ভাবে মনে হয়না।
0 Comments:
Post a Comment