গোবিন্দরাম মিত্র-দ্যা ব্ল্যাক জমিদার? মানে কি?
অসৎ উপায়ে জমিদার হয়েছিলেন?
না। আসলে এটা ছিল সরকারি
পদ।
এরকম অদ্ভুত নাম কেন?
সবটা জানতে চান? তাহলে
পড়ুন।
সময়টা ছিল কোম্পানির
শাসনের একেবারে শুরু। ১৭০০ সালের প্রথম দিক। কলকাতায় তখন কোম্পানির শাসন অনেকটা
আধাস্বপ্ন- আধাবাস্তব এই অবস্থায় চলছে। কিন্তু ভালকরে ব্যাবসা করতে গেলে তো মোঘল
বাদশার ফরমান দরকার। অনেক আলাপ আলোচনার পর অবশেষে ১৭১৫ সালে সারম্যান একজন দূত পাঠালেন
ফারুখশিয়ারের কাছে। মনে পড়ছে ইতিহাসের সেই সারম্যান দৌত্যর কথা? হ্যাঁ এই
পরিকল্পনা হয়েছিলো কলকাতাতে বসেই। অবশেষে ১৭১৭ সালে মিলল ঐতিহাসিক ফারুখশিয়ারের
ফরমান। ফরমান অনুসারে তো পুরো বাংলাদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার কোম্পানি
পেলই সেইসাথে পেল হুগলী নদীর উভয় তীরে প্রায় ১০মাইল অবধি ৩৮টি গ্রাম কিনে নেওয়ার
অধিকার। এই অধিকার বলে কোম্পানি হয়ে গেলো সম্পূর্ণ ২৪ পরগণার জমিদার। ভাল করে
দেখুন একটা জিনিস, জমদার হল কিন্তু কোম্পানি অর্থাৎ কোন একজন লোক নয়। তাহলে জমদারি
চালাতে গেলে তো একজন প্রশাসকের দরকার। এই সময়ে কোম্পানি তৈরি করল ‘জমিদার’ নামের
একটি পদ যিনি কলকাতা তথা পুরো বাংলাদেশ শাসনের সর্বেসর্বা। তাঁর হাতে দেওয়া হল
জমিদারির সমস্যা বিচার থেকে আইন ভঙ্গ কারির সাজা ঘোষণা সব। এমনকি তিনি চাইলে কোন
অভযুক্তর ফাঁসি অবধি দিতে পারেন তবে তার জন্য কোম্পানির মূল কতৃপক্ষের অনুমতি
লাগত। আর মাসিক মাহিনা ২০০০ টাকা। কিন্তু সমস্যা হল অন্য যায়গায়। যারা জমিদার হয়ে
কলকাতায় আসবে তারা তো আর জানেনা যে কলকাতা তথা বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা ঠিক
কেমন। তবে উপায়। তৈরি হল ডেপুটি জমদার পদ। এই পদে নিয়োগ করা হবে একজন নেটিভ বা দেশি
লোক। এই ডেপুটি জমিদার পদের নাম কোম্পানির সাহেব কর্মচারীরা দিয়েছিলেন ব্ল্যাক
জমিদার।
১৭২০সাল প্রথম ব্ল্যাক
জমিদার হিসাবে নিযুক্ত হলেন গোবিন্দরাম মিত্র।প্রায় ৩৫ বছর এই পদে আসীন ছিলেন
তিনি। মাসিক মাহিনা মাত্র ৩০ টাকা। কিন্তু এই পদ নিয়ে ইতিহাসে একটি কথা প্রচলিত
আছে যে “এই পদে যে খুটে খতে পারবে তার আর খাওয়ার অভাব হবেনা” অর্থাৎ অসৎ উপায়ে
প্রচুর আয় কিন্তু কাজ করতে হবে কোম্পানি বাহাদুরের চোখ এড়িয়ে। ধূর্ত গোবিন্দরাম এই
পথে এতবেশি উপার্জন করলেন যে একজন দেশীয় জমিদারের সমান সম্পত্তি করে ফেললেন,
কিন্তু তার নিষ্পাপ বহিঃআচরণ কোনভাবেই কোম্পানির কর্তাদের মনে আচরণের সৃষ্টি
করেনি। কিছু বছর পর তিনি কোম্পানির কাছে আবেদন করলেন মাহিনা বাড়ানোর। মঞ্জুর হল
সেই আবেদন নতুন মাসিক মাহিনা হল ৫০ টাকা। সে যাইহোক সাথে তো উপরি ইনকাম আছেই। অনেক
টাকার মালিক গোবিন্দ রাম প্রতিষ্ঠা করলেন কুমোরটুলি মিত্র বাড়ি। এবং হালসীবাগানের
উত্তরে নন্দবাগানে তৈরি করলেন নিজেস্ব বাগানবাড়ি। কিন্তু যে কাজের জন্য তিনি
ইতিহাসে পরিচিত তাহল চিৎপুরের নবরত্ন মন্দির প্রতিষ্ঠা। এই মন্দির ছিল হলয়য়েল
মনুমেন্টের থেকেও উঁচু এবং মন্দিরের চুড়ার ওপরে ছিল সোনার তৈরি ধ্বজা এবং মন্দিরে
পূজিত হত শিব মূর্তি। পরবর্তী কালে এই মন্দিরে আনা হয় কালী মূর্তি। ঝড়ে ধ্বংস হয়ে
গেলেও মন্দিরের সবথেকে ছোট গম্বুজটি আজও আছে। এই মন্দিরেরই আজকের চিৎপুরের
সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির।
কিন্তু সুখ বেশিদিন সহ্য হয়না। ১৭৫২ সালে গোবিন্দরামের
জীবনে জীবন্ত শনি হয়ে এলেন John Zephaniah Holwell । যথেষ্ট চতুর
এবং বুদ্ধিমান লোক ছিলেন হলওয়েল। কলকাতাতে এসে গোবিন্দরামের সম্পত্তি দেখেই সন্দেহ
হয়, জানতে চান তার আয়ব্যয় এবং জমার হিসাব। এমনকি তার আয়ের সমস্ত উৎস সম্পর্কে
জানতে চাইলেন। আর যদি গোবিন্দরাম সেটা না জানান তাহলে জেল অথবা ফাঁসি। কিন্তু যে এতদিন
উপরি কামাই করেছে সেকি আর সহজে দমে যাওয়ার লোক? সহজেই একে একে কোম্পানির কর্তাদের
হাত করে নিতে লাগলেন। লোকের মুখে এই কথা চলত যে এসবই ব্ল্যাক জমিদারের ব্ল্যাক
মানির কাজ। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হয়নি। ফাঁসি বা জেল হইনি ঠিকই কিন্তু বরখাস্ত
হয়েছিলেন।
এইরকম অসৎ কাজ শুধু গোবিন্দরামেই
থামে থাকেনি তাঁর ছেলে। রাধারাম মিত্র হাত পাকিয়ে ছিলেন দলিল জাল করার কাজে।
এইকাজের জন্য তাঁর ফাঁসির দণ্ড হয়। এই মিত্র পরিবার এখনও আছে কিন্তু রাধারামের পরে
এই পরিবারে আর অসৎ উপায়ে কাউকে আয় করতে শোনা যায়নি। এই পরিবারের সদস্য পঞ্চানন মিত্র
(১৮৯২-১৯৩৬) ছিলেন এই দেশের প্রথম Anthropology-এর অধ্যাপক।
শুধু চামড়ার নামেই ব্ল্যাক না,
সমপরিমাণ ব্ল্যাক কারবারও ছিল কি বলেন?
আজ এই অবধি সামনের দিন বলবো দুজন
ব্যক্তির কথা যারা জালিয়াতি নয় রীতিমত বুদ্ধি আর পরিশ্রমের জোরে বড়লোক হয়েছিলেন।
0 Comments:
Post a Comment