পাথুরিঘাটার মল্লিক পরিবারঃ (The Mallick family of Patharghata)


অষ্টাদশ শতাব্দিতে যারা বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন তাদের মধ্যে পাথুরিঘাটার মল্লিক পরিবার বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। এই মল্লিক পরিবারের আদি পুরুষ সোমভদ্র দেব।  তাঁর ২২তম অধস্তন পুরুষ হলেন বৈদ্যনাথ দেব। তাঁর পুত্র কৃষ্ণদাস এবং কৃষ্ণদাসের পুত্র রাজারাম মল্লিক উপাধি নিয়ে ত্রিবেণী ত্যাগ করে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। রাজারামের পুত্র দর্পনারায়ন মল্লিক  এবং রাজারামের অনুজ প্রাণবল্লভের পুত্র শুকদেব মল্লিক কলকাতাতেই জন্মগ্রহণ করেন। দর্পনারায়নের পুত্র নয়নচাঁদ ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় জন্ম গ্রহন করেন।


এবার আসি আসল কথায় পলাশির যুদ্ধের পর মীরজাফর কলকাতা আক্রমণের ক্ষতি পুরন হিসাবে কয়েক কোটি টাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দান করেন। এই টাকা ভাগ করার জন্য ১৩ জন নেটিভ কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। এই ১৩ জনের মধ্যে এই পরিবারের শুকদেব এবং নয়নচাঁদ দুজনেই ছিলেন। এছাড়া আগে যাদের কথা বলেছি অর্থাৎ শোভারাম বসাক, রতন সরকার এবং গোবিন্দরাম মিত্র সকলেই ছিলেন।

বর্তমান কলকাতার মল্লিক বংশ এই শুকদেব এবং নয়নচাঁদদের বংশ থেকেই উদ্ভূত। নয়নচাঁদের ছেলে নিমাই চরণ মল্লিক কলকাতার বিখ্যাত ব্যাক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। কারণ তিনি মুর্শিদাবাদের জগৎ শেঠের থেকেও ধনী ছিলেন। তিনি ইংরেজদের সাথে মিলে আমদনি-রপ্তানির ব্যাবসা করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেন। তিনি নুন এবং জমিজমার ফাটকা খেলে বেশ কিছু টাকা অপচয় করলেও বেশ কয়েক কোটি টাকা রেখে যান। কিন্তু ভাগের মা গঙ্গা পায় না। এই টাকার ভাগ কে কত নেবে তাই নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ কয়েক বছর মামলা চলেছিল নিমাই চরণের আট পুত্রের মধ্যে এবং ৬ লক্ষ টাকা ব্যায় হয়েছিল।

কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করলে কিহবে এই ৮জন পুত্রের মধ্যে কয়েকজন বেশ খ্যাতনামা ব্যক্তি হয়েছিলেন।

নিমাই চরনের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামগপাল সিঁদুরিয়া পটিতে নিজের বাড়ি তৈরি করেন এবং ওই বাড়িতেই হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ এবং মেট্রোপলিটান থিয়েটার প্রতিষ্ঠা হয়। এই থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিধবা বিবাহ’ নাটক।

নিমাই চরনের কনিষ্ঠ পুত্র মতিলাল মল্লিক পাথুরিঘাটার মল্লিক বাড়িটি নির্মাণ করেন। মতিলাল মল্লিকের দত্তক পুত্র যদুলাল মল্লিক ১৮৭৩-৮৫ সময়কালে কলকাতা কর্পোরেশনের কমিশনার ছিলেন। এই পদে থাকাকালীন সরকারী কর্মচারিদের কঠোর সমলচনার জন্য  কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান স্যার হেনরি হ্যারিসন তাঁকে “দ্যা ফাইটিং কক” নামে অভিহিত করেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।  

পঞ্চম পুত্র রামমোহন মল্লিক বড়বাজার ক্রস স্ট্রীটে বাড়ি তৈরি করেন।

সপ্তম পুত্র স্বরূপচাঁদ মল্লিক মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির পূর্ব দিকে নিজের বাড়ি তৈরি করেন এবং পিতৃ শ্রাদ্ধে ৭লক্ষ টাকা এবং মাতৃ শ্রাদ্ধে ২লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। তাঁর অর্থ সাহায্যেই ভাবানিচরন বন্দ্যোপাধ্যায় পুঁথির আকারে হিন্দু শাস্ত্র সমূহ প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি হিন্দু ধর্মের প্রচারের জন্য উইলে ৩২লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেন।

নিমাই চরন নিজে একটি গঙ্গার ঘাট তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেই ঘাটই আজকের নিমাই চরন মল্লিক ঘাট। নিমাই চরন মল্লিকের প্রপৌত্র দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি আউটডোর বিভাগ এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে একটি চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজা উপাধি পান।

আজ এই অবধি সামনের দিন বলবো আর এক মল্লিক পরিবারের কথা।

0 Comments:

Post a Comment