কলকাতায় ছাপাখনার বিকাশ(DEVELOPMENT OF PRINTING PRESS IN KOLKATA) :



শিক্ষার প্রসারে বই যেমন একটি মাধ্যম ছিল তেমনি ছাপাখানাও শিক্ষাকে বিশেষ প্রভাবিত করেছিল। ছাপাখনার বহুলতার আগে বাংলা তথা ভারতের শিক্ষা ব্যাবস্থার মূল উপকরন বই ছিল হাতে লেখা। যার ফলে শিক্ষা একটি ছোট গণ্ডির মধ্যে আবধ্য ছিল, ছাপাখানা এই গণ্ডি ভেঙ্গে শিক্ষাকে সার্বজনীন করে তোলে।কিন্তু এখানে বাধ সাধল কিছু সনাতনি মানুষ কারণ শিক্ষা সার্বজনীন হলে শিক্ষিত বলে যে দম্ভ সেটা তাদের আর থাকবে না। তারা প্রচার করতে লাগলেন যে বিদেশিদের ছাপানো বই অস্পৃশ্য এবং তার দিকে তাকানও পাপ, তাদের আরও বক্তব্য যে এই ছাপানো বই হিন্দু ধর্মকে নষ্ট করার একটি যন্ত্র মাত্র।

কিন্তু ছাপানো বই জনসমাজের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলে যে সনাতনীদের প্রচার করা বানী অচিরেই বিলিন হয়ে গেল। মজার কথা হল যে ছাপানো বই কিনে জনসাধারণের পড়ার স্রোতে সনাতনীরাও সহজেই ভেসে গিয়েছিল। সত্যি বলতে ছাপা বইয়ের প্রচলন না হলে কলকাতার শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রসার এত সুগম হত না।

১৭৭৮ সালে কলকাতা ও হুগলীতে ছাপাখান বিদ্যমান ছিল কিন্তু তাতে প্রকাশিত হত কোম্পানির প্রয়োজনীয় দলিলপত্র আর যা বই ছাপা হত তা মূলত ফিরিঙ্গীদের উপকারের জন্য, সর্বসাধারণের জন্য ছাপাখনা তখন ছিলনা। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে সর্বসাধারণের জন্য ছাপাখানা তৈরি হয় এবং ক্রমে কলকাতা মুদ্রনের পীঠস্থান হয়ে ওঠে।

উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। তারা প্রথমে ছেপে প্রকাশ করতে থাকে দেশের জনপ্রিয় বই যেগুলো মূলত হাতে লেখা পুঁথির মাধ্যমে পড়ান হত। যেমন কৃত্তিবাসের রামায়ন, কাশীরাম দাসের মহাভারত, ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি বই ছেপে বেড়তে লাগল শ্রীরামপুর থেকে। শ্রীরামপুর থেকে রামরাম বসু প্রকাশ করলেন তার রাজা প্রতাপদ্যিত্য চরিত্র ও রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় প্রকাশ করলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং। এছাড়া নিয়মিত প্রকাশিত হত শ্রীরামপুর স্কুলের পাঠ্যপুস্তক।

কিন্তু কলকাতাতে ১৮১৭ সালে স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা হবার পর এই সোসাইটি বই ছাপানয় বিশেষ ভূমিকা নিল ফলে শ্রীরামপুরের ভূমিকা কিছুটা ফিকে হয়ে আসে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদেশ্য ছিল দেশের ধনী থেকে গরিব সবার মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। ফলে একের পর এক প্রকাশিত হতে লাগল বিভিন্ন সহজ বোধ্য ও উপযোগী পাঠ্যপুস্তক । রাজা রামমোহন রায় লিখলেন বাংলা ব্যাকরণ, রাজা রাধাকান্ত দেব লিখেন ১২৮ পাতার একটি বই যাতে বর্ণমালা থকে ইতিহাস অবধি সব বিষয়ের সম্মক ধারণা ছিল। এছাড়া স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে রাধাকান্ত দেব, তরিনী চরণ মিত্র ও নীলকমল সেন যুক্ত ভাবে একটি বই লিখলেন যার নাম ‘নীতিসার’।

এরপর পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং মুদ্রণে বিপ্লব আনলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে এরা যুক্ত ভাবে স্থাপন করলেন একটি ছাপাখানা। এই ছাপাখানা থেকে বিদ্যাসাগর প্রকাশ করলেন বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, আখ্যামনঞ্জরি, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, ব্যাকরণ কৌমুদি প্রভৃতি বই। এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রকাশ করলেন তিন খণ্ডের “শিশুশিক্ষা”।

এরপর প্রকাশ পেল প্রথম মহিলা দ্বারা রচিত সাহিত্য। ১৮৫৬সালে কৃষ্ণকামিনী দাসী প্রকাশ করলেন ‘চিত্তবিলাসিনী’ কাব্যগ্রন্থ। ১৮৬৭সালে রাসসুন্দরী দেবী প্রকাশ করলেন ‘আমার জীবন’। এই দুটিই প্রথম মহিলা দ্বারা রচিত ও প্রকাশিত প্রথম বই।

বটতলার প্রকাশনাঃ বর্তমান নিমু গোস্বামী লেন ও আহিরীটোলার সংযোগ স্থলে ছিল একটি বটগাছ। ১৮২০ সালে এই বটগাছের নিচেই বিশ্বনাথ দেবের হাত ধরে বটতলা সাহিত্য এবং প্রকাশনের জন্ম। এই প্রকাশনের মূল উদেশ্য ছিল গ্রামের প্রতিটি কোনায় পৌঁছে দিতে হবে বইকে। এইধারনা নিয়ে এই বটগাছের নিচে শুরু হয় সস্তায় বই ছাপিয়ে কম দামে ফেরিওয়ালা মারফত গ্রামে গ্রামে বিক্রি। 

বিশ্বনাথ দেবের পর বানেশ্বর ঘোষ এই বটতলার প্রকাশনের ধারনাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।বানেশর ঘোষ বর্ধমান জেলার চলবলপুর গ্রাম থকে এসে কলকাতাতে একটি মুদির দোকান খোলেন। কিন্তু তার মনে ছিল যে কম দামে সকলের কাছে বই পৌঁছে দিতে হবে, এই আশা নিয়ে খোলেন “সুলভ পুস্তকালয়” এবং প্রকাশ করতে থাকেন বাজার চলতি বইয়ের সস্তা সংস্করণ এবং ফেরিওয়ালা মারফত গ্রামের ও শহরের গরিব পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে থাকেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুমতিক্রমে তিনি প্রকাশ করলেন সস্তার বর্ণপরিচয়এর পর থেকে প্রকাশ করতে থাকেন রামায়ণ, মহাভারত ও নানা শাস্ত্র গ্রন্থ। এই ‘সুলভ পুস্তালয়’ আজও বেঁচে আছে কিন্তু নাম পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান নাম ‘আনান্দ এজেন্সি’।

আশাকরি বোঝা গেলো বটতলার সাহিত্য এর ধারনার উদ্ভব কি করে? তার আজ থকে বটতলার সাহিত্য নিয়ে মুখরোচক আলোচনা করার আগে ভেবে দেখবেন নিজের ঐতিহ্য কে কতটা কলুষিত করছেন।

বই ছেপে প্রকাশিত হওয়ার প্রায় ৫০-৬০ বছরের মধ্যে লোক ছাপা বইয়ের মাধ্যমে পরতে ও লিখতে শিখল এবং আসতে আসতে ছাপা বই হয়ে উঠল লোকের নিত্য দিনের সঙ্গী। এর পরের যুগের সাহিত্য, নাটক, ইতিহাস, দর্শন, সংবাদপত্র সবই কলকাতার দান। ও ক্রমাগত কলকাতা হয়ে উঠল জ্ঞানকাণ্ডের পীঠস্থান। আজ একটু ফিকে হলেও কলকাতা সেই ভূমিকা আজও অটুট রেখেছে। 

বই ও তার প্রকাশ তো অনেক হল কিন্তু এই বইত পরতে হবে তার জন্য চাই স্কুল। হ্যাঁ স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা সবই তৈরি হয়েছিল কলকাতায়। 

সেই ইতিহাস জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে পরের ব্লগের জন্য। 


অজানা কলকাতা টুইটার (ojana Kolkata in twitterhttps://twitter.com/KolkataOjana?lang=en

অজানা কলকাতা ফেসবুক পেজঃ https://www.facebook.com/OJANA-Kolkata-351064638888700/?modal=admin_todo_tour


1 comment: