আপনারা কেউ ব্যারাকপুর
চিড়িয়াখানায় গেছেন?
আজকের জনবহুল এবং ক্যান্টনমেন্ট শহর ব্যারাকপুরে চিড়িয়াখানা ? বলেন কি?
হ্যাঁ। ছিল, ব্যারাকপুরে চিড়িয়াখানা ছিল। আসুন শুরু করি সেই গল্প।
পলাশীর যুদ্ধের পরথেকে ব্যারাকপুর নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সাহেব মহলে। গঙ্গার ধারে মনরম পরিবেশ নজর কাড়তে থাকে ইংরেজ কোম্পানির। অবশেষে ১৭৭২ সালে তৈরি হল প্রথম সেনা ব্যারাক। এর পরথেকে ক্রমে ব্যারাকপুর হয়ে উঠল দ্বিতীয় রাজধানী। তৈরি হল লাটসাহেবের বাগানবাড়ি। তবে ব্যারাকপুরের সত্যিকারের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ওয়েলেসলি।
ওয়েলেসলির ব্যারাকপুরের বাগানবাড়িটি মনে হয়েছিল ‘কুটির’/ “ কর্টেজ”। তাই হুকুম হল তৈরি করতে হবে বাগানবাড়ি। ১৮০২-১৮০৩ শুরু হল বাগানবাড়ি তৈরির কাজ। ২৫০ একর জমির ওপর ১৮০৪ সালের মধ্যে গড়ে উঠল বিরাট বাগান, পুর্নাঙ্গ চিড়িয়াখানা আর বাংলোর ভেতরের ভাগ শুধু তৈরি হল। খরচের বহর দেখে লর্ড ওয়েলেসলিকে বড়লাট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। বন্ধ হয়েগেল বাংলো তৈরির কাজ।
কিন্তু কেন হঠাৎ চিড়িয়াখান তৈরি করতে গেলেন তিনি? উত্তর পাওয়া গেছিল অনেক পরে। আসলে ১৮০০ সালে তৈরি হওয়া ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইনস্টিটিউশান গড়তে চেয়েছিলেন ওয়েলেসলি। মাথায় পরিকল্পনা আসার সাথে সাথে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রথমে গার্ডেনরিচে ১৮০০-১৮০৪ সালের মধ্যে ৩৫০ পাউন্ড খরচ করে যে পশু সংগ্রহালয় গড়ে তুলেছিলেন সেটাই তুলে এনে চিড়িয়াখানার রূপ দিলেন ব্যারাকপুরে। ঠিক করলেন প্রতি প্রজাতির জন্তুর খাঁচার বাইরে সেই প্রজাতির বিষয়ে বিস্তারিত লেখা থাকবে ইংরাজি, উর্দু ও বাংলা ভাষায়।
দেশের সর্বত্র কোম্পানির কর্মচারীদের চিঠি লিখে পাঠালেন, নির্দেশ দিলেন স্থানীয় জীবজন্তুর নমুনা পাঠাও। ডাঃ ফ্রান্সিস(অভিজ্ঞ ও উৎসাহী পশুতত্ত্ববিদ) বুকানন নিযুক্ত হলেন সংগ্রহশালার তত্ত্বাবধায়ক এবং গবেষক হিসাবে এবং সাথে একজন চিত্রকর। বাজেট ঠিক হল মাসে ১০০০টাকা। পশুপাখির ভরণপোষণের খরচ মাসে ৫০০টাকা। চিত্রকরের মাইনা মাসে ১০০টাকা, রং ও তুলির জন্য মাসে ৬০টাকা, একজন কেরানির মাইনা মাসে ৪০টাকা নতুন জন্তুজানোয়ার কেনার জন্য মাসে ৩০০টাকা। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকল নতুন নতুন জন্তু। ভরে উঠতে থাকল অ্যালবাম। এই অ্যালবাম আজও রক্ষিত আছে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে। এই অ্যালবামে আছে ৩০০০ রকমের জীবজন্তুর হাতে আঁকা ছবি এবং আলোকচিত্র এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রতিটা প্রজাতির বর্ণনা আছে বাংলা, উর্দু এবং ইংরাজি ভাষায়। আবার অনেক ছবিতে আছে বাঙালি হালদার পদবীর চিত্রকর এর সাক্ষর।
তবে বেশিদিন চলেনি এই সুখের সময়, ১৮০৫ সালে ওয়েলেসলি বিদায় নেবার পরের বছর ছুটি নিলেন বুকানন। যদিও ডাঃ ফ্লেমিং এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য উইলিয়াম লয়েড গিরনিস এই চিড়িয়াখানার দায়িত্ব সামলে যান ভালোভাবেই কিন্তু ১৮০৮ সালে।
এর পরেও এই চিড়িয়াখানা টিকেছিল। লর্ড মিন্টো ১৮১২ সালে নিজের বিবাহবার্ষিকী পালন করলেন চিড়িয়াখানায়। রিতিমত সপ্তাহান্তে ব্যারাকপুরে গিয়ে থাকতেন বড়লাট, গঙ্গার মনোরম দৃশ্য উপভগ করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রমদ তরী “সোনামুখি” তে করে ব্যারাকপুর যেতেন লাটসাহেব, যাতে ছিল শ্বেতপাথরের বাঁধানো বৈঠকখানা, ড্রেসিংরুম, মার্বেলবাথ সব। ১৮১০ সালে মারিয়া গ্রাহাম ব্যারাকপুর ভ্রমণ সম্পর্কে লিখেছেন যে “ চাঁদের আলোয় ওয়েলেসলির অসমাপ্ত প্রাসদটকে মনেহয় প্রাছিন কোন ধ্বংসাবশেষ” তিনি সেখানে দেখেছিলেন পেলিকান, ফ্লেমংগো, জাভার পায়রা, ইত্যাদি হরেক পশুপাখি।
১৮১৪ সালে লেডি নুজেন্টের বর্ণনায় আছে কালোচিতা, উটপাখির বর্ণনা।
১৮১৭-১৮ সালে ফ্রান্সিস রডন হেস্টিংস ৬০৩০টাকা খরচ করে তৈরি করলেন নতুন পক্ষীশালা, ১৮২২ সালে নতুন জন্তু এনে নতুন খাঁচা তৈরি করিয়ে চিরিয়াখাকে সাজালেন নতুন করে ফলে জমির পরিমান বেড়ে দাঁড়াল ৩০০ একর।
১৮২৩ সালে বড়োলাট হয়ে এলেন লর্ড আমহার্স্ট। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন এই সংগ্রহশালা দেখে। একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন আফ্রিকার সিংহ থেকে তিব্বতের বাইসন এমন কি ক্যাংগারু অব্দি ছিল সেই চিড়িয়াখানাতে। বিপত্তি ঘটা শুরু হল সেইসময় থেকেই, কোম্পানি আপত্তি জানাতে থাকে চিড়িয়াখানার অতি খরচের ব্যাপারে। ফলে বাধ্য হয়ে আফ্রিকার সিংহ এবং কিছু বাঘ বিলিয়ে দেন দেশী রাজাদের মধ্যে।
বিপত্তি শুরু হল বেন্টিঙ্কের আমলে। কোন উৎসাহ নেই তার এই ব্যাপারে। বার্ষিক ৫০০ টাকা খরচ করতেও রাজিনন তিনি। তবুও টিকে ছিল এই চিড়িয়াখানা। ১৮৩৭ সালে এমিলি ইডেন জানাছেন চিড়িয়াখনা রিতিমত ভর্তি সে সময়। বেবুন, জিরাফ, বাদর, গণ্ডার সবই ছিল, তার এই কাহিনিতে তিনি তার দেহরক্ষীর সাথে গণ্ডারের লড়াইয়ের দৃশ্য লিপিবধ করেছেন। কলসওয়ার্দি গ্রান্ট চিত্রায়িত করেন এই দৃশ্য। সমসাময়িক সময় পরিকল্পনা হতে থাকে কলকাতাতে পুর্নাঙ্গ জুলজিকাল পার্ক তৈরির। বেন্টিঙ্ক সেই কথায় কান না দিয়ে দেদার বিলিয়ে দিতে থাকেন পশুপাখি।
লর্ড ক্যানিং বড়লাট হয়ে আসার পরে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ওয়েলেসলির সাধের চিরিয়াখানার অবস্থা ফিরিয়ে আনেন। এই সময় কাবুলের শাসক দোস্ত মোহম্মদ অবাক হয়ে গিইয়েছিলেন জিরাফ দেখে।
এরপর থেকে কেউ আর ফিরেও তাকায়নি এইদিকে। ১৮৬৭এ লর্ড লিটনের আমলে প্রায় ৩০ বছরের আলোচনার পর তৈরি হয় আলিপুর জুলজিকাল পার্ক। তার পাশে ধুঁকতে থাকে ওয়েলেসলির সাধের চিড়িয়াখানা। ভারতে আসার পর সংগ্রহশালার দুরাবস্থা দেখে মর্মাহত লিটন সব পশুপাখি সযত্নে সরিয়ে নিয়ে গেলেন আলিপুরে। অবলুপ্ত হল ব্যারাকপুর চিরিয়াখানা। আজও তার স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে আলিপুর জুলজিকাল গার্ডেন।
চিড়িয়াখানা তো নেই কিন্তু সেই নাম আজও আছে, “ব্যারাকপুর চিড়িয়া মোড়” যার নাম এসেছে এই চিড়িয়াখানা থেকে। একটি ছোট্ট স্মৃতি চিহ্ন ওয়েলেসলির সাধের চিড়িয়াখানার।
কলকাতার হারিয়ে
যাওয়া দুটি চিড়িয়াখানাঃ পর্বঃ ২ (two unknown zoo of kolkata:part:2)
https://ojanakolkata.blogspot.com/2019/05/two-unknown-zoo-of-kolkatapart2.html
অজানা কলকাতা টুইটার (ojana Kolkata in twitter) https://twitter.com/KolkataOjana?lang=en
অজানা কলকাতা ফেসবুক পেজঃ https://www.facebook.com/OJANA-Kolkata-351064638888700/?modal=admin_todo_tour
👍👍
ReplyDelete