হাওড়া ব্রিজ। কলকাতা বললেই যে নামটা আগে মনে আসে সেটা হল হাওড়া ব্রিজ আর মাঝেসাঝেই পাগল কলকাতার হাওড়া ব্রিজে উঠে পরেছে বলেও শোনা যায়। কিন্তু আজকের হাওড়া ব্রিজ্রের
সাথে মজাদার গল্প জরিয়ে থাকলেও জরিয়ে আছে বেশ মজাদার কিছু ইতিহাস। অনেকেই মনে করেন যে আজকের হাওড়া ব্রিজ
যেখানে আছে সেখানে আগে কোন সেতুই ছিলনা।কিন্তু আসল কথা হল সিপাহী বিদ্রোহেরও আগে এই
সেতু তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় অনেক পরে। আসুন জানেনি
সেই ইতিহাস।
১৮৫৩ সালে মুম্বাই থেকে
থানে প্রথম রেলপথ স্থাপন করল গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিন্সুলার রেল কোম্পানি প্রথম ২১
মাইল দীর্ঘ রেল পথ স্থাপন করার ঠিক পরের বছর ১৮৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
হাওড়া থেকে হুগলী রেল পথ স্থাপন করলে হাওড়া যাতায়াতের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু হাওড়া স্টেশনে যেতে গেলে মূল বাধা
ছিল গঙ্গা নদী। কিন্তু সেই সমস্যাও মিটেছিল অচিরেই। শুরু হয়েছিল ফেরি যোগাযোগ আর
ধনী মানুষদের ছিল নিজেদের স্টিমার। সব ভালই চলছিলো কিন্তু সমস্যা দেখাদিল ১৮৬৬ সাল
নাগাদ। ততদিনে রেলপথ দিল্লি অবধি বিস্তৃত হয়েছে ফলে হাওড়া স্টেশন দেশের ব্যাস্ততম
স্টেশন গুলোর মধ্যে একটি, ঠিক এই সময়ে ঘটল কয়েকটি নৌকাডুবি। কারণ? অনুসন্ধান করে
দেখাগেলো অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ক্ষমতার বেশি যাত্রী এবং মাল বহন করাতেই এই
দুর্ঘটনা।
এবার উপায়? ইংরেজ সরকার
ঠিক করলেন তৈরি হবে ব্রিজ সেই সাথে দেখতে
হবে জেন জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে।
যেমন কথা তেমনি কাজ।
ইঞ্জিনিয়ার ব্রাডফোর্ড লেসলি তৈরি করলেন ১৫২৮ ফুট লম্বা এ্লেন।ভাসমান বা পনটুন
ব্রিজ তৈরি করে ফেললেন। জাতে হেঁটে যারা সেতু পার হবেন তাদের জন্য ফুটপাথের সুবিধাও
করেদেন তিনি আর সেই সাথে জাহাজ যাওয়ার সময়ে সেতুকে খুলে দুভাগ এবং অল্পসময়ে জুড়ে
দেওয়ার ব্যাবস্থাও ছিল।এই সেতু তৈরি করতে তৎকালীন সময়ে খরচ হয়েছিল ২২ লক্ষ টাকা। এক
কথায় সময়ের থেকে যথেষ্ট আধুনিক হয়ে উঠল কলকাতা।
কিন্তু ১৯০৬ সালে সরকার
এবার স্থায়ী ব্রিজের কথা ভাবা শুরু কিন্তু একটা ব্রিজ থাকতে আবার কেন? একটা কারন
হল ট্রাফিক অনেক বেড়ে গেছে সেই সাথে গরু আর ঘোড়ার অসুবিধা হছে। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন
গরুর সমস্যা। আসলে সেই সময়ের বেশিরভাগ যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল গরু আর ঘোড়ার গাড়ি।
যেহেতু ব্রিজ ভাসমান ছিল তাই জোয়ারের সময়ে ব্রিজ এত উপরে উঠে যেত যে ব্রিজের ওপরের
গরু আর ঘোড়া নিচে নামতে পারতনা আর আর যে উঠতে চায় সে উঠতে পারেনা। তাই আবার হুকুম
ব্রিজ বানাও।
কিন্তু বানাও বললেই তো আর
বানান যায়না অনেক কিছু ভাবতে হয়। প্রথমেই কোথায় হবে? একই যায়গায় হলে বিকল্প কি
হবে? বিকল্প নয় হল কিন্তু কি রকম ব্রিজ হবে? ক্যান্টিলিভার? আর্চ? ফ্লোটিং? সাসপেন্সন?
হাজার প্রশ্নও।
কিন্তু আশায় জল ধেলে দিল
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ। কাজ পিছিয়ে গেল ১৯২০ অবধি। ১৯২০ সালে কাজ শুরু হয়েও সেই একই
প্রশ্নও একই আলোচনা। এই করে কেটে গেলো রামের বনবাস, প্রায় ১৪ বছর। অবশেষ ১৯৩৫ সালে
ইংরেজ সরকারের কারিগরি বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার
স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জী তৈরি করলেন কান্টিলিভার সাস্পেনসন ব্রিজ-এর নকশা। এবং
৮ বছর ধরে কাজ চলার পর ১৯৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী অবশেষে তৈরি হল আজকের হাওড়া
ব্রিজ। এই হাওড়া ব্রিজ তৈরির বরাত পান Braithwaite,
Burn & Jessop Construction , ২৬৫০০ টন
স্টিল যোগান দেয় টাটা স্টিল কোম্পানি এবং আলোর বরাত পায় Philips । আজও হাওড়া
ব্রিজে যে আলো জলে সেটা Philips কোম্পানির। কিন্তু তখন টিকেছিল পুরনো পলটুন হাওড়া ব্রিজ। অবশেষে ১৯৪৫ সালে পুরনো হাওড়া ব্রিজ অপ্রয়োজনীয় এবং সর্বোপরি নিরাপত্তার খাতিরেই ভেঙ্গে ফেলা হয়। ১৯৪৫ সালে মার্চ মাসে আজাদ হিন্দ বাহিনি মনিপুর এবং ইম্ফল দখল করলে ইংরেজ সরকার নতুন হাওড়া ব্রিজকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়ার সিধান্ত নেয় কিন্তু তা আর হয়নি।
সবথেকে মজার কথা হল যে
আজও হাওড়া ব্রিজের কোন সমস্যার সমাধানে Braithwaite, Burn & Jessop Construction এবং টাটা স্টিলের
সাহায্য নিতে হয়। ২০০৫ সালে একটি স্টিমার হাওড়া ব্রিজের নিচে আটকে যায় তাতে
ব্রিজের কিছু অংশের লোহার পাত পরিবর্তনের দরকার হয় যার জন্য Braithwaite, Burn & Jessop Construction টাটা স্টিল কে
চিঠি লিখে সেই সময়ের একই গুনমানের লোহা তৈরি করে দিতে বলেন। হ্যাঁ শুনতে অবাক লাগলেও
এটাই করতে হয়েছিল।
সবশেষে এটা বলতেই হয় যে
ইংরাজরা অত্যাচার করেছেন ঠিকই কিন্তু আজকের সময়এর মতো ভ্যাজাল জিনিস দিয়ে ব্রিজ
তৈরি করেনি তাইতো ৭৬ বছরের পুরনো ব্রিজ হয়েও প্রতিদিন ৩ লক্ষ গাড়ি এবং সাড়ে ৪ লক্ষ
পথচারীর চাপ বিনা বাধায় বহন করে চলেছে।
অবাক করার মতো বিষয়।। ভাবতেও ভালো লাগে যে একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার এটির নকশা তৈরি করেছেন।।।
ReplyDelete👍👍
ReplyDelete