কলকাতায় পণ্ডিতদের আগমন এবং হিন্দু আইনের রচনাঃ(The arrival of scholars in Calcutta and the writings of Hindu law):


কলকাতায় পণ্ডিতদের আগমন এবং হিন্দু আইনের রচনাঃ



কলকাতায় পণ্ডিতদের আগমনের মূল উদ্যোগতা ছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাটা রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তিনি কলকাতায় পণ্ডিতসভা প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্ডিতদের কলকাতায় এনেছিলেন। তিনি কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে চতুষ্পদী স্থাপনের জন্য অর্থ সাহায্য করতে থাকেন। এছাড়া তিনি নিজের বাড়িতে “বিচারের” আয়োজন করতেন এবং তাদের পরিতোষিক দিতেন। ১৮৫৪সালের ২১শে মে তারিখের প্রকাশিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ অনুসারে মহারাজ বাহাদুর একবার ১সপ্তাহ ব্যাপী বিচারের আয়োজন করেছিলেন এবং বিশেষ কিছু পণ্ডিত যেমন শঙ্কর তর্কবাগীশ, বলরাম তর্কভুষন, মানিক্যচন্দ্র তর্কভুষন, বানেশর বিদ্যালঙ্কার, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রমুখ পণ্ডিতদের ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পরতিষিক দিয়েছিলেন। এইসময় রঘুমণি বিদ্যাভুষন চিৎপুরের নবাব দেলয়ার জঙ্গ এর অনুমতিক্রমে চিৎপুরে একটি চতুষ্পদী স্থাপন করেন। নবকৃষ্ণ দেবের এই ধারা তার পৌত্র রাধাকান্ত দেবও বজায় রেখেছিলেন, তার সভাপতি ছিলেন কাশীনাথ তর্কালঙ্কার। হাতিবাগানে তার একটি চতুষ্পদী ছিল। এই সময়ের পণ্ডিতদের সাহিত্য চর্চা নিয়ে ওয়ার্ড সাহেব তার ।‘হিন্দুদের ইতিহাস,সাহিত্য এবং পৌরাণিক উপাখ্যান’ সম্পর্কিত বইয়ের চতুর্থ খণ্ডে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করে গেছেন।

এতক্ষণ আমরা জেনেছি যে রাজারা শাস্ত্রীয় বিচারের আয়োজন করতেন এবং সেই বিচারে এবং বিজয়ই পণ্ডিতদের পুরস্কৃত করতেন। ইংরেজ শাসন আসার পড়ে ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সুপ্রিমকোর্ট স্থাপন হল এবং এখানে হিন্দু ধর্ম সংক্রান্ত বিধান দেওয়ার জন্য পণ্ডিতদের আহবান করা হল। কারণ ঔরঙ্গজেবের সময় থেকে ‘ফাতাওয়া-ই-আলমগিরি’ নামে মুসলিম আইন শাস্ত্র ছিল কিন্তু হিন্দুদের এরম কোন আইন শাস্ত্র ছিলনা। এজন্যই বিচার বিভ্রাটে হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ডাকা হত। হেস্টিংস এই সমস্যা সমাধানের জন্য হিন্দু আইন রচনার উদ্যোগ নেন। তিনি ১১জন পণ্ডিতকে নির্বাচন করেন এবং হিন্দুদের সনাতন ধর্ম গ্রন্থের ভিত্তিতে তাদের কাছে এই আইন শাস্ত্র রচনার ভার প্রদান করেন। তারা হলেনঃ রামগপাল ন্যায়লঙ্কার, বীরেশ্বর পঞ্চানন, কৃষ্ণজীবন ন্যায়লঙ্কার, বানেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃপারাম তর্কসিধান্ত, কৃষ্ণচন্দ্র সার্বভৌম, গৌরীকান্ত তর্কসিধান্ত, কৃষ্ণদেব তর্কালঙ্কার, সীতারাম ভট্ট, কালিশঙ্কর বিদ্যাবাগীশ এবং শ্যামসুন্দর ন্যায়সিধান্ত। এনারা প্রথমে যে আইনগ্রন্থটি রচনা করেন তা প্রথমে ফার্সি ভাষায় ও পরে ন্যাথানিয়াল ব্রাসি হলহেড ইংরাজিতে আনুবাদ করেন(১৭৭৫-১৭৭৬খ্রিঃ)।  কিন্তু এতবার ভাষান্তরিত হওয়ার কারণে গ্রন্থটি মূল গ্রন্থ থেকে পৃথক হয়ে পরে। সেজন্য পুনরায় একটি বিশুদ্ধ গ্রন্থ রচনার দরকার হয়ে পরে। তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোন্স এই গ্রন্থ রচনার ভার দেন মিথিলার স্মার্ত পণ্ডিত সর্বরি ত্রিবেদীর ওপর। এবং এই ভার ত্রিবেদী অর্পন করেন একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিতের ওপর। যার নাম জগন্নাথ তর্কপঞ্চান-এর ওপর। তিনি ৮০০ পাতার একটি পুস্তক রচনা করেন। যার নাম “বিবাদ ভুঙ্গার্নব” এবং ত্রিবেদী এই বইয়ের নামকরন করেন “বিবাদ সারার্নব”। সর্বপ্রথম হেস্টিংসের আমলে যে বইটি রচনা করা হয়েছিলো তার নাম হল “বিবাদর্ণব সেতু”। কোলব্রুক সাহেব জগন্নাথ তর্কপঞ্চান-এর বইটির ইংরাজি অনুবাদ করেন এবং নাম দেন “DIGEST OF HINDU LAW ON CONTRACTS & SUCCESSION.” 

আসুন জেনে নেওয়া যাক এই জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন সম্পর্কে কিছুকথা.১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্ম।পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ২৪ বছর বয়েসে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে একজন দক্ষ ও জ্ঞানী নৈয়ায়িক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই খ্যাতি দীর্ঘ ৭৭ বছর বজায় রাখেন। মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের পণ্ডিতসভাও অলঙ্কৃত করেছেন জগন্নাথ পণ্ডিত। রাজা নবকৃষ্ণ দেব তাঁকে পাকা বাড়ি এবং তালুক তৈরির জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন। রাজা তাঁকে বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা আয়ের একটি জমিদারী প্রদান করতে চাইলে তিনি বলেন যে এতে তার পরবর্তী প্রজন্ম বিলাসী হয়ে পর্বে এবং বিদ্যা চর্চা থেকে সরে আসবে তাই তিনি এই জমিদারী ফিরিয়ে দেন। ইংরেজরা তাঁকে জজ পণ্ডিত নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। সারা জীবন নিজেকে বিদ্যা চর্চা এবং অধ্যাপনাতেই ব্যাস্ত রাখেন। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে ১১১ বছর বয়সে দেহত্যাগ করে।   

1 comment: