ব্রিটিশদের ব্যবসা চুক্তি এবং জাত ব্যবস্থার বিলোপঃ

কলকাতায় প্রথম এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ এবং তার পরবর্তীতে অনেক ছোট ব্যবসাদাররা কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। এবং এই সময় থেকেই কলকাতায় বিদেশী জাতি ব্যাবসা করতে থাকে। এই সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলেছি সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলিকাতার নামকরণ ও বাণিজ্যের ইতিহাস এই ব্লগে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে জাত ব্যাবস্থা বলতে কি আমি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় প্রভৃতি জাতের কথা বলছি? না। আসলে এখানে জাত ব্যাবস্থা হল ব্যবসায়িক জাত ব্যাবস্থা। কে কি ব্যবসা করছে তার ওপর ভিত্তি করে জাত প্রথা এবং সম্পূর্ণটাই মানুষের মন গড়া।

যেমন কলকাতার সনাতন পরিবার বা ব্যবসাদারদের কথা যদি বলতে হয় তাহলে সবার আগেই উঠে আসে সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ- দের কথা কারণ কলকাতায় বিদেশী ব্যবসাদার আসার আগেথেকে এনারা ব্যবসা করছেন। মূলত সুতোর ব্যবসা ছিল বলে এনাদের বলাহয় তন্তুবায় সম্প্রদায়। আবার বিদেশী ব্যবসাদাররা আসার সাথে সাথে অনেক ব্যাবসাদার রা কলকাতায় চলে আসেন যেমন যারা সোনার ব্যবসা করত তাঁরা পরিচিত হন স্বর্ণ বনিক হিসাবে, কাঁসার ব্যবসা যারা করত তাঁরা কংসবণিক হিসাবে। আবার মাটির মূর্তি গড়ার কাজ যারা করতেন তাঁরা পাল সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত হলেন বাবার তাঁরা যেখানে থাকতেন সেখানকার নাম হল কুমোরটুলি। এরম ভাবে অনেক সম্প্রদায় কলকাতায় এসেছে এবং বিভিন্ন স্থানের নাম হয়েছে যেমন দর্জি পাড়া, আহিরিটোলা প্রভৃতি। সাধারনত স্বর্ণবনিক, কংসবণিক, তন্তুবায় এরা কুমোর, কামার , দর্জি প্রভৃতি সম্প্রদায়কে নিচু চখে দেখত। কিন্তু ইংরেজরা কলকাতায় বাণিজ্য করার অধিকার পাওয়ার পরে প্রথমেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ দের সাথে ব্যবসা চুক্তি করেন শুধু এখানেই থেমে তাকেননি নিজেদের প্রয়োজনে এবং লাভের জন্য পায় সন সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্যবসা চুক্তি করেন এবং দাদন* দেন। এই ঘটনা যে সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং জগৎ শেঠ ভাল ভাবে নেয়নি সেটা আপত্তি জনিয়েই বুজিয়ে দেন শুধু তাই নয় তাঁরা কোম্পানির কাছ থেকে যে দাদন নেবেন না তাও বলেন। ভবিষ্যতে যে বাঙালি নিজেদের কৌলীন্য বৃত্তি হারিয়ে ফেলার যে প্রবনতা দেখতে পেয়েছিল টা এই ঘটনা থেকেই বুজতে পারি।

কোম্পানি কলকাতায় যে সময়ে লাইসেন্সে প্রথা আনে সেই সময় যে বাঙালি কৌলীন্য বৃত্তি হারাচ্ছিল তা বুঝতে পারি কারণ এই এইসময়ে কোম্পানি বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন কারবার করার লাইসান্সে দিয়েছিল।প্রথম ১৭৩৮ সালে ইংরাজ কোম্পানি গ্লাস তৈরি, আতশবাজি তৈরি, নারকেল দড়ির কারখানা করার জন্য লাইসেন্সে প্রদান করেছিলেন। আবার ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ ঘোষ লাইসেন্সে নিয়েছিল আয়নার কারখানার জন্য, মনোহর মুখোপাধ্যায় লাইসেন্সে নিয়েছিল নৌকা ও বোটের কারবারের জন্য, আতসবাজির জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন ময়নদ্দি বারুদওয়ালা, সিন্দুর প্রস্তুতির জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন নারায়ন সামন্ত, মেটে সিন্দুর এবং হিরাকস প্রস্তুতির জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন ফকির চাঁদ দত্ত, গাঁজা ও সিদ্ধির দোকানের জন্য লাইসেন্সে নিয়েছিলেন বাবুরাম ঘোষ।

১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে যারা লাইসেন্সে নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, আয়নার কারখানার জন্য বাবুরাম ঘোষ,  মেটে সিন্দুর,হিরাক্‌তুতে এবং ফটকিরির -এর জন্য জগন্নাথ হালদার,আতসবাজির জন্য কালিচরন সিংহ, সিদ্ধির দোকানের জন্য  আনন্দরাম বিশ্বাস।

এতক্ষণ যা বললাম তাতে এটা বোঝাগেলো যে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় সমস্ত রকম বাঙালি সবরকম ব্যবসায় নিজেদের নিয়োজিত করে। এই সময়ের অনেক বাঙালি ইংরেজদের সাথে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করে বিশেষ ধনপতি হয়েছিলেন। তাদের সকলের কথা প্রায় “কলকাতার বাঙালি বড়লোক” এই সিরিজ-এ বলেছি। তবুও এখানে তাদের নাম গুলো জেনে নেওয়া যাক। তন্তুবায় গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বৈষ্ণবচরন শেঠ, তাম্বুলি গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গোবর্ধন রক্ষিত, সুবর্ণ বনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সুখময় রায়, মথুরামোহন সেন, প্রাণকৃষ্ণ লাহা, লক্ষ্মীকান্ত ধর, মতিলাল শীল, সাগর দত্ত প্রমুখ। কায়স্থ হয়েও যারা ব্যবসাতে অংশগ্রহণ করেছিলে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন গোকুল দত্ত, মদন দত্ত, রামদুলাল সরকার।চিন্তা নেই ব্রাহ্মণের সাথেও পরিচয় হবে।  

সামনের পর্ব থেকে বিভিন্ন বাঙালির ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা কর। কথা দিছি ভাল লাগবে। একটু অপেক্ষা করুন।

·        দাদন কি?

দাদন কথাটি এসেছে ফরাসি দাদনি কথা থেকে, যার অর্থ হল অগ্রিম। ইংরেজরা ভারতীয়দের সাথে ব্যবসায়িক চুক্তি করে তাদের অগ্রিম প্রদান প্রথা চালু করেন। একেই বলে দাদন প্রথা। অনেকটা আজকের advance দেওয়ার মতো।


COFFEE HOUSE KOLKATA- কলকাতা কফি হাউস




ফি হাউস, উত্তর কলকাতায় কলেজে পড়েছেন বা উত্তর কলকাতায় চাকরি করেছেন কিন্তু কখনও কফি হাউসে যাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল । কিন্তু সৌভাগ্য বসত আমি কলকাতার কলেজে না পড়ে এবং কলকাতায় চাকরি না করেও অনেকবার কফি হাউস গিয়েছি কারণ আমার প্রিয় যায়গা কলেজস্ট্রীট। আর বিখ্যাত কফি হউস এই কলেজস্ট্রীতেই। কিন্তু আজকে এই বিষয়টা নিয়ে কেন লিখতে বসলাম? আসলে যারা কফি হউস-এ আসেন, সে ভারতীয় হোক বা বিদেশী সকলেই মনে করেন এটাই কলকাতার প্রথম কফি হাউস। কিন্তু আসলে তা নয়। তাই আসুন শুনেনি কফি হাউসের দীর্ঘদিনের পথ চলার কথা।

১৭৬২ সালের ২১শে জুন উইলিয়াম পার্কেস নামে এক সাহেব কোম্পানির কাছে আবেদন করলেন যে তিনি শহরের একটি প্রান্তে বাগান বাড়ি কিনেছেন এবং সেখানে তিনি আমদ প্রমদের জন্য একটি কফি রুম খুলতে চান। প্রস্তাবটি যথেষ্ট উত্তম ছিল কিন্তু ভয় ছিল অন্য যায়গায়। কোম্পানির জোয়ান ছেলে ছোকরা রা যদি আমদ প্রমদের জোয়ারে ভেসে জায় তাহলে কোম্পানির ব্যবসা মাথায় উঠবে। তাই একটি শর্তে অনুমতি পাওয়া যাবে সেটি হল অফিসের টাইম- এ এই কফি রুম বন্ধ রাখতে হবে। এই শর্ত মেনেই কফি রুম চালু হল এবং অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।
১৭৮০ সালে কোম্পানির এক ইংরেজ কর্মচারী তার বিবরনে লিখেছেন যে “খাবারের দাম খুব কম, এক ডিশ কফির দাম মাত্র এক সিক্কা টাকা। আর কিছু অতিরিক্ত নেওয়া হয় তার কারণ অন্য।” সেই অন্য কারণ হল যে সেই কফিরুমে থাকতো অঢেল ইংরাজি পেপার এবং বই।

কিন্তু অল্পবয়সীদের এতে মন ভরলনা। তার চাই আর যায়গা এবং আরো ব্যবস্থা। এই আবেদন থেকেই ১৭৮৮ সালে তৈরি হল ক্যলকাটা এক্সচেঞ্জ কফি হাউস, যার বর্তমান নাম রয়েল এক্সচেঞ্জ। এই কফি হাউসে একমাত্র কলকাতার কোম্পানির কর্মচারী, কর্মকর্তা এবং বনিকরাই প্রবেশ করতে পারবে এবং তার জন্য সকলকে সদস্য হতে হবে এবং চাঁদা মাসিক ৪ টকা। এখানে কফি, খাবার, আমদ প্রমদের সাথে মজুত ছিল কলকাতা, লন্ডন এবং মাদ্রাজের সমস্ত ইংরাজি কাগজ এবং রাজনৈতিক খবরের একাধিক পত্রিকা। শুধু গল্প আর খাওয়েই নয় এই কফি হাউসে কফির কাপে চলত চরম বিতর্ক। যে মেজাজ আজও বজায় আছে। কিন্তু সুখের সময়ে হটাত ই খারাপ খাবর ঘনিয়ে এল। একদিন মালিক ঠিক করলেন তিনি এই কফি হাউস বিক্রি করে দেবেন কারণ আড্ডা জমলেও ব্যবসা ঠিক জমছে না তাই বিক্রিয় করাই শ্রেয়। কিন্তু খরিদ্দাররা বেঁকে বসলেন। বিক্রি করা যাবেনা এই কফি হাউস। ঠিক হল কফিহাউস বাঁচাতে লটারি হবে ঠিক হল, টিকিটের দাম থাকবে  ১০০ টাকা এবং ১৬০০০ টিকিট থাকবে,। কিন্তু লটারি করে এই কফি হাউস বাঁচানো গেছিল কিনা জানা যায়নি। কোন নথিতেও উল্লেখ নেই।

ঠিক এই সময়ে লন্ডনে এক প্রকারের কফিহাউস ছিল যার নাম ‘জেরুজালেম কফি হাউস’ ১৮৮৮ সাল অবধি টিকে ছিল এই সংস্থা। কবি কিউপারের পিতৃ নিবাস “কিউপার কোর্ট”-এ ছিল এই কফি হাউস টি। ভারত ফেরত নাবিক, কোম্পানির কর্মকর্তাদের মুল আড্ডা ক্ষেত্র ছিল এই যায়গা। ভারতের গল্প শুনতে অনেক জোয়ান ছেলের সমাগম হত। হিকি ভারতে আসার আগে এখানেই শুনেছিলেন ভারতের কথা।

১৭৯০ সালে জন ম্যাকডোনাল্ড নামে এক ব্যক্তি কলকাতায় পা দিয়েই উপলব্ধি করলেন জেরুজালেমের মাহাত্য। তিনিও একটি বাড়ি কিনলেন ডালহৌসি স্কয়ারে এবং জেরুজালেম কফি হাউসের আদলে তৈরি করলেন একটি কফি হাউস। কফিহাউসটির অবস্থান ছিল বর্তমানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রীট যেখানে মিশেছে সেখানে ছিল এই কফি হাউস টি কিন্তু ব্যবসা ঠিক জমেনি। ফলে একদিন লর্ড ডালহৌসি ম্যাকডোনাল্ড-এর কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নিলেন কারণ সিভিলিয়ানদের জন্য কলেজ তৈরি করবেন। ১৮০০ সালে সেই কফি হাউস উঠে গিয়ে তৈরি হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।

আবার তিন দশক পর ১৮৩৬ সালে কফি হাউস প্রেমীদের জন্য সুখবর এল Alexender’s east india magazine এ খাবর প্রকাশিত হল যে জেরুজালেম কফিহাউসের মত একটি নতুন কফিরুম খুলবে কলকাতায়। সেই সাথে সেখানে বিভিন্ন জায়গার কাগজ, জাহাজ আশা যাওয়ার খাবর এবং লন্ডনের জন্য ডাকের থলি ওখানেই বাধা হবে।
এই রকম সুবিধা যুক্ত হোটেল তখন একটাই ছিল না কলকাতায়। লন্ডন হাউসে তৈরি হল স্পেন্সাস হোটেল যেটি ছিল বর্তমানের হেস্টিংস স্ট্রিট এবং গভরমেন্ট প্লেস ওয়েস্ট এর সংযোগ স্থলে। স্বাধীনতার পর সেটি তৈরি হয় কেন্দ্রীয় সরকারের ট্রেজারি অফিস এবং বর্তমানে সেটি আয়কর দপ্তরের অফিস।

ঠিক একি রকম সুবিধা যুক্ত হোটেল তৈরি হল কলকাতায় যেটির নাম ছিল অকল্যান্ড হোটেল। ১৮৫৮ সালে শুরু হয় এই হোটেল। এখানে ছিল জেরুজালেম কফি রুম, পড়ার আলাদা ঘর, আমোদ-প্রমোদের জন্য আলাদা ঘর এবং কালচারাল অনুস্থানের জন্য আলাদা ঘর। কিছু বছর পর হোটেলের নাম পরিবর্তন হয়ে হল নীল উইলসন হোটেল। যুক্ত হল রাত্রি যাপনের সুবন্দোবস্ত। এরও কিছু বছর পর জেরুজালেম কফি রুমের চাহিদা কমে যাওয়ায় উঠে যায় কফি রুম। এর পর অনেক হাত বদল এবং পরিবর্তনের পর সেই হোটেল আজও টিকে আছে গ্রেট ইস্টান হোটেল নামে।

আর শেষে আসি আজকে যে কফি হাউস দেখেন তার কথায়। এই কফি হাউসটি আজকের যায়গায় প্রথম ত্থেকে ছিলনা। ১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতার  আলবার্ট হল-এ প্রথম কফিহাউস টি প্রতিষ্ঠা হয়। এইসময়ে এতি মুলত ছিল গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আড্ডার যায়গা।    ১৯৪২ সালে কফি বোর্ড গঠন হওয়ার পড়ে যৌথ ভাবে এই কফিহউস চলতে থাকে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পড়ে এই কফিহউসের নাম হয় INDIAN COFFEE HOUSE. ১৯৫৮ সালে কতৃপক্ষ এই কফি হউস বন্ধ করে দিতে চায় কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপকদের হস্তক্ষেপে এবং অনুরোধে কফি হাউস আবার নতুন করে বর্তমান যায়গায় চালু হয়। এর পর নানা বাধা বিপত্তি এসেছে কিন্তু কফি হাউস তার অবস্থানেই আছে।

এখনকার যুগের ঝাঁ চকচকে কফি শপের কাছে জৌলুস ফিকে হয়ে গেলেও কফি হাউসের আড্ডা, চাহিদা, আমেজ প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থাকবে।  






কলকাতায় জনবসতি যে ইংরেজ আমলের আগেও ছিল এবং ইংরেজদের আগে যে আর্মেনিয়ানরা যে কলকাতাকে তাদের বাণিজ্য ক্ষেত্র তৈরি করেছিল এবং কলকাতায় বাণিজ্য বিস্তার এবং পলাশির যুদ্ধে জেতায় আর্মেনিয়ানদের ভূমিকা এবং সর্বোপরি কলকাতার নামকরণ- এই সবনিয়ে আমি মত চারটে আর্টিকেল লিখেছি।


কিন্তু ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে অনেকরই অসুবিধা হচ্ছে যে কারণে সম্পূর্ণ একটি আর্টিকেল –


কলকাতার সৃষ্টি
ESTABLISHMENT OF KOLKATA

কলকাতাঃ কিভাবে তৈরি হল?-সূচনাপর্ব (KOLKATA (CALCUTTA): HOW TO ESTABLISH?-THE INTRODUCTION)
কলকাতা দ্যা সিটি অফ জয়, এই নামেই আমরা আমাদের শহর তিলত্তমাকে জানি। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক কলকাতাকে সিটি অফ প্যালেস বলেও অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই কলকাতা তৈরি হল কেমন করে? ১৬৯০ সালের ২৪শে অগাস্ট জোব চারনক ই কি তবে কলকাতা তৈরি করেছিল? উত্তর হল না। কলকাতার ইতিহাস আরও পুরনো, আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস।

কলকাতার ইতিহাস জানতে গেলে জানতে হবে দক্ষিণবঙ্গ-র ইতিহাস যা কিনা ২০০০ বছরের বেশি পুরনো।
খ্রিস্টপূর্ব ৮০০-৯০০ সালের মধ্যে লেখা হয় মহাভারত যা সেইসময় জয়সংহিতা নামে পরিচিত ছিল। এই মহাভারত-এ উল্লেখ আছে যুধিষ্ঠির যেসময় রাজসুয়া যজ্ঞ করছেন ভিম সেইসময় তাম্রলিপ্ত-তে এসে সেখানকার স্থানীয় রাজার সাথে যুদ্ধ করেন। এই তাম্রলিপ্ত বর্তমান সময়ে মেদিনীপুর জেলার তমলুক। এবং এই তমলুক এর নিকটবর্তি গনগনইডাঙা নামক স্থানে ভিমের সাথে বকাসুরের যুদ্ধ হওয়ার উল্লেখ আছে। তাই কম হলেও মেদিনীপুর-এর অনেক স্থানে ভিম-এর পূজা হয়।

এরপর আসাযাক ৫০০ খ্রিস্টাব্দতে, এইসময় বরাহমিহির-এর লেখাতে সমতট নামক একটি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবস্থান বিচার করলে সেইস্থানের অবস্থান হয় বর্তমান দক্ষিণেশ্বর থেকে বেহালা পর্যন্ত। এরপর ৫১৭ খ্রিস্টাব্দতে ভারতে আসেন চিনা পরিব্রাজক হিউ–এন-সাং সমগ্র গঙ্গা সমভূমি অঞ্চলকে ৫টি ভাগে ভাগ করেছেন, উত্তরে পৌণ্ড্র, উত্তরপূর্বে কামরূপ, পূর্বে সমতট, দক্ষিণ-পশ্চিমে তাম্রলিপ্ত/ তাম্রলিপ্ত বন্দর, পশ্চিমে কর্ণসুবর্ণ যেখানে শশাঙ্ক রাজত্ব করেছেন। এবং এই অংশ এর উল্লেখ আছে চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাসে যা দে-গঙ্গার ইতিহাস নামেও পরিচিত।
চন্দ্রকেতুগড় গুপ্ত যুগের সমাসাময়িক এবং এইসময় যে বর্তমান কলকাতাতে জন বসতি ছিল তার প্রমান পাওয়া যায় বর্তমান কালীঘাট –এর কাছে পাওয়া গুপ্ত যুগের মুদ্রা থেকে।

শুশুনিয়া পাহাড়ে (জোন্দ্রাতে) যে শিলালিপি পাওয়া গেছে সেটা চন্দ্র রাজা সিংহ বর্মণের শিলালিপি নামে পরিচিত যেটাকে বাংলা ভাষার আদিরূপ বলা হয়। এই সময় থেকেই দক্ষিণবঙ্গে আর্য এবং অনার্য সংস্কৃতির মিলন ঘটতে থাকে। বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা আর্য এবং অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণ।
 

এবার ফিরে আসি কলকাতার ইতিহাসে, আমারা জানি যে কলকাতার আগের নাম ছিল ক্যালকাটা, ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারী নাম সরকারি ভাবে হয় কলকাতা।এর পরেই সাবর্ণ চৌধুরি-র পরিবার এবং ৯জন বিশিষ্ট মানুষ কলকাতা হাইকোর্ট-এ মামলা করে যে জোব চারনক কোনভাবেই কলকাতার সৃষ্টিকর্তা নন। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিমাই সদন বসু এবং ৫জন ঐতিহাসিক-এর কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেন তার অপর ভিত্তি করে ১৬ই মে ২০০৩ সালে ঐতিহাসিক রায় দান হয়-“জোব চারনক কলকাতার স্রষ্টা নন” যা বদলে দেয় কলকাতার ইতিহাস এবং সামনে আসে আসল ইতিহাস।

এতক্ষণ যা বলেছি তাতো রিপোর্টে ছিলই এবং আরও ছিল যে জোব চারনক-এর প্রায় ৩০০ বছর আগেও কলকাতাতে জন বসতির উল্লেখ পাওয়া যায়।

কলিকাতা, বারুইপুর, চিতপুর, কালীঘাট, প্রভৃতি
  স্থান এর কথা বিপ্রদাস রচিত মনসামঙ্গল কাব্যতে ৯ম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যা লেখা হয়েছিল ১৫শতাব্দিতে। তবে এর আগে ১৩শতাব্দিতে কনা হরি দত্ত লিখেছিলেন তবে এরো পরে আরও ৪-৫ জন মনসা মঙ্গল কাব্য লিখলেন, সব কটাতেই কলিকাতার উল্লেখ আছে এবং একটি বিশিষ্ট জনপদ।
তবে বর্তমান কলকাতা এবং কলিকাতা এই দুটো আলাদা আসলে সেসময় কলিকাতা, গোবিন্দপুর এবং সুতানুটি এই ৩টি জনপদ নিয়ে জোব চারনক
 সূচনা করলেন বৃহত্তর কলকাতার।

এই ৩টি গ্রাম এর ইতিহাস কিন্তু মোঘল আমলের। পড়ুন সেই ইতিহাস।

সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলিকাতার নামকরণ ও বাণিজ্যের ইতিহাস ( name and trade history of sutanuti, gobindopur and kolikata )


আমার   আগের কলম-এ কলিকাতা নামক স্থান বা জনপদ এর কথা বলেছি কিন্তু এই কলিকাতা বর্তমান কলকাতা নয়, বর্তমান কলকাতার একটি অংশ মাত্র। বর্তমান কলিকাতা সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতার মিলিত রূপ।
আসুন  জেনে  নেওয়া  যাক  তিনটি  জনপদ  এর  কিছু  ইতিহাসঃ


১) সুতানুটি -  এই  অংশের  নামকরণ  নিয়ে  বিস্তর  মত  বিরোধ  আছে। বর্তমান  উত্তর  কলকাতার  নিমতলা- জোড়াবাগান  অংশ  ছিল  তৎকালীন “সুতানুটি ” বা  “চুথানুটি”।  সাধারণ  ভাবে  বলা  হয়  সুতা এবং  নটীর  ব্যবসা  থেকে এই  অংশের  নাম  হয়  “সুতানুটি” আবার তিহাসিকরা  বলেছেন  জাহাঙ্গির, মানসিংহ, বড়িশার  সুবর্ণ  রায় চৌধুরিকে  কলকাতা  জায়গির  হিসাবে  দান করেন।  এই  রায় চৌধুরি পরিবারের  আরাধ্য দেবতা  "শ্যামরায়”  এই রায়চৌধুরী  বাড়ির ঠাকুর মন্দিরের  সামনে  ছিল  এক  বিরাট  ছত্র,  এই  অংশে  প্রতিদিন  পুজার  শেষে  প্রসাদ বিতরণ  বা  লুট  হতো ।  এই  থেকে   
ছত্রলুট - সুতালুটি - সুতানটি - সুতানুটি।
এই  অংশে  জোব  চারনক  প্রথম  বাণিজ্য কুঠি স্থাপন  করেন।


২) গোবিন্দপুর - তৎকালিন  গোবিন্দপুর  হলো  বর্তমান  ফোর্ট উইলিয়াম   তার  পার্শ্ববর্তী  অংশ।  অনেকের  মতে  ভগবান  গোবিন্দ  জউ –এর নাম  অনুসারে  এই  অংশের  নাম  হয়  গোবিন্দপুর । তবে অপর এক দলের মতে রাজা বসন্ত রায়ের কর্মচারী গোবিন্দ দত্ত নামে এক ব্যক্তি স্বপ্ন দেখেন ভগবান গোবিন্দ জউ তাকে আদেশ করছেন “মাটি খোড়, টাকা পাবি। গোবিন্দ  দত্ত  কালিঘাটের  কাছে  তার পছন্দ মতো  জায়গা  খুড়ে  অনেক  টাকা  পেলেন। সেই থেকে জায়গার নাম হয় গোবিন্দপুর।


৩) কলিকাতা বা ডিহি কলিকাতা - এই অংশের নামকরণ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে এই অংশ সুবর্ণ রায় চৌধুরির জমিদারীর আওতায় ছিল যা মোগল বাদশাহ-র কাছ থেকে পাওয়া। এই অংশ হলো আজকের ডালহৌসি স্কোয়ার বা বি বা দি বাগ।

এই তিন জনপদের বাণিজ্যের ইতিহাসঃ


পূর্ব এশিয়াতে ইউরোপে বাণিজ্য করার জন্য সুবিধাজনক অবস্থান এবং হুগলি নদীতে বাণিজ্য বাজরার যাতায়াতের সুবিধা থাকার জন্য ষোড়শ শতাব্দিতে পর্তুগীজদের আগমন হয়। তারা হুগলী নদীর ওপর
অববাহিকার আদি সপ্তগ্রামে প্রথম বাণিজ্য কুঠির নির্মাণ করেন। কিন্তু নদীর গতি পরিবর্তন এবং বার বার বন্যার কারণে তারা নিজেদের ঘাটি নদীর পূর্ব দিকে সরিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হন সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝি নানা বাঙ্গালী ব্যবসায়ী পরিবার এবং মারোয়ারীর জগৎ শেঠ এই অংশে সুতো এবং সুতীর ব্যবসা করেন।
১৬২০ খ্রীষ্টাব্দে জগৎ শেঠ এবং বসাকদের সুতো, ছাপার কালি, লবণ, চুনের রমরমা ব্যবসা শুরু করে। এর পরে মিত্র, ঘোষ, মল্লিক, সেন, পরিবার সুতানুটি গ্রামে এসে ব্যবসা শুরু করেন। পর্তুগীজ এবং ডাচরা এই অংশে বাণিজ্য খুটি নির্মাণ করে প্রতিনিধির সাহায্যে ব্যবসা চালাতে থাকেতারা মূলত দ্রব সংগ্রহ করত,  গুদামে মজুত করতো এবং রপ্তানি করত।

১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথম এলিজাবেথ এর কাছ থেকে রয়েল চার্টার পায়, তারা ভারতে এসে সুরাট এবং মাদ্রাজ বন্দর থেকে ব্যবসা শুরু করেন। ১৬৫৩ সালে সম্রাট শাহ সুজার কাছ থেকে বাংলাতে বাণিজ্য করবার জন্য পাটনা, ঢাকা, কাশিমবাজার, মালদা, রাজমহল প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অধিকার পায়। তারা হুগলি এবং  কাশিমবাজারে  বাণিজ্য  খুটি নির্মাণ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে | ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দে জোব চারনক একবার কলিকাতায় আসেন, তবে সুবেদার সায়েস্তা খানের কাছ থেকে বাধা পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন, পরে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় এসে সুতানুটি অঞ্চলে ব্যবসা শুরু করেন।

১৬৯০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে বিবর্তনঃ


১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ হলেও ইংরেজদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়নি। ১৬৯৫ সালে কাঁচা বাড়ীর সংখ্যা ছিল ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার এবং পাকা বাড়ী ছিল ৮ থেকে ১০টি। মোট জনসংখ্যা ছিলা ৪০০০ থেকে ৫০০০ এবং মোট জমির পরিমাণ ছিল ১৮৫০ বিঘা। মুষ্টিমেয় অধিবাসি ছিল ইংরেজ এবং বাকী স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ী এবং উপজাতি। কোলকাতার বহু পাড়ার নাম এসেছে এই উপজাতিদের ও ছোটো ব্যাবসায়ী শ্রেণির নাম থেকে । যেমন- কুমোরটুলি, কুলুটোলা, দরজী পাড়া প্রভৃতি।

১৬৯২ সালে জানুয়ারীতে চারনকের মৃত্যু হলে তার জামাই চার্লাস আইয়ার এবং অন্যান্য আধিকারিকরা ব্যবসা চালিয়ে যান। ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আজম উন শান বাধ্য হন সুতানুটি, কলিকাতা এবং গোবিন্দপুরের সম্পূর্ণ জমিদারী ইংরেজদের প্রদান করতে।
স্যার গোল্ড সবরোর হাত ধরে ব্যবসার অভিমুখ ডিহি কলিকাতার দিকে আসে। ১৬৯৯ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের কাজ শুরু হয়। ১৭০০ সালে ফারুকশিয়ারে ফরমান বলে বার্ষিক ৩০০০/- টাকার বিনিময়ে বাংলা, বিহার, ওড়িশায় ব্যবসা করার অধিকার পায় এবং লীজ হিসাবে পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকের আরো এলাকা অধিকার পায় এবং আধুনিক বৃহত্তর কলকাতা সৃষ্টির সূচনা হয়।

কিন্তু কলকাতা নাম কীভবে এল? পড়ুন
 

"কলকাতা" নামকরনের পিছনে বিতর্ক ( CONTROVERSY BEHIND THE "CALCUTTA" NOMINATION)


১৪৮৫ তে লেখা বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল এবং ১৫৮০ তে মুকুন্দরামের চন্ডিমঙ্গলে কলিকাতার উল্লেখ আছে। তবে এই কলিকাতা বর্তমান কোলকাতা কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ আছে।

সুনিতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এই অংশে শামুকের খোলপচিয়ে চুন তৈরী করা হতো, তাই কলিচুন থেকে কোলকাতার উৎপত্তি। কোলকাতা বিশেষজ্ঞ পি.নায়ার বলেছেন ক্যালকাটা হলো কোলকাতার ইংরাজী রূপ। তার মতে প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান সল্টলেক থেকে হেষ্টিংস ট্রিট হয়ে প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে এসে একটি খাল গঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছিল। এই “খাল-কাটা” থেকে কোলকাতা নাম এসছে।


আবার শোনা যায়, কালিকথা বা কালিঘাট থেকে কোলকাতার নামের উৎপত্তি ।

১৬৮৮ সালে ২২শে জুন জব চারনকের একটি লেখা চিঠিতে এবং ১৬৮৯ সালে চার্লস আইয়ারের, ইলিহু ইয়েলকে লেখা চিঠিতে ক্যালকাটা” কথার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কলকাতা  নাম  কিভাবে  এলো? এই বিতর্ক আজও চলছে। এর মধ্যে থেকে যে কোন একটিকে
কলকাতার নামকরণের সুত্র বলে ধরা নেওয়াই যায়

WHO IS THE CREATOR OF KOLKATA? BRITISH OR ARMENIAN?-কলকাতার সৃষ্টিকর্তা কে? ব্রিটিশ নাকি আর্মেনিয়ান?


সাধারন ভাবে আমরা জেনে আসছি ১৬৯০ সালে জব চারনক কলকাতায় পদার্পণ করে এবং কলকাতার সূচনা। আমি আমার প্রথম দুটি ব্লগে প্রমান করেছি যে ব্রিটিশ আসার আগে কলকাতার অস্তিত্ত ছিল জাকে নতুন রুপ দিয়েছিল ইংরেজরা। কিন্তু কলকাতায় প্রথম কোন বিদেশী শক্তি এসেছিল? ব্রিটিশ নাকি আর্মেনীয়? এই প্রশ্নের উত্তর আর্মেনীয়। কিন্তু কিভাবে?


কলকাতার হাওড়া ব্রিজের নিকটে আর্মেনীয় স্ট্রিট এবং আর্মেনীয় চার্চ এই কথা প্রমান করে যে কলকাতায় আর্মেনীয়রা এসেছিলেন। সেটা ব্রিটিশ দের আগে নাকি পরে সেটা বুঝতে গেলে এই চার্চ-এর ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে হবে।
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ইউরোপ নিবাসী আর্মেনিয়ানদের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যার বিষয়বস্তু ছিল যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন স্থানে আর্মেনিয়ানদের জন্য গির্জা তৈরি করে দেবে। এই চুক্তি সাক্ষর করেন কম্পানির পক্ষ থেকে Sir Josia Child এবং আর্মেনিয়ান দের পক্ষ থেকে Khoja Sarhad এবং Khoja Phanoosh। এই চুক্তির ভিত্তিতেই ১৬৮৮ সালে বর্তমান গির্জার দক্ষিণপূর্ব শাখায় কাঠের তৈরি গির্জার প্রতিষ্ঠা হয়। শুধু তাই নয় সেই গির্জায় ৪০ জন আর্মেনীয়দের বসবাসের ব্যাবস্থা করেন এবং যেসব পুরোহিত নিয়োগ করা হত তাদের ৫০ পাউন্ড করে মাসিক পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাবস্থাও ছিল। কিন্তু একটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুরনো গির্জাটি পুড়ে গেলে ১৭৩৪ সালে Aga Mamed Hazaar Maliyar নামক একজন আর্মেনীয় ১৭৩৪ সালে গির্জার বর্তমান ভাবনটি তৈরি করেন। যেখান ব্রিটিশদের দারা কলকাতায় প্রথম গির্জা তৈরি হয় St. John's Church, ১৭৮৭ সালে । এবং কলকাতায় আর্মেনিয়ানদের অনেক আগের থেকেই উপস্থিতির জোরালো প্রমান হল আর্মেনিয়ান চার্চ- এর কবরস্থানে আর্মেনীয় ব্যক্তি সুখিয়া সাহেবের স্ত্রি Rezabeebeh –এর কবর, যার মৃত্যু হয় ১৬৩০ সালের ২১শে জুলাই।


কিন্তু আর্মেনিয়ানরা কি ব্রিটিশদের কলকাতায় আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছিল? এই উত্তর খুজতে গিয়ে একজন আর্মেনীয় ঐতিহাসিক (নাম আমার অজানা) কলকাতা এবং লন্ডনে ব্রিটিশদের ঐতিহাসিক দলিল খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেন বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য, যেমন- কলকাতায় তিনটি জনপদ(কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর)-এর মালিকানা থেকে ১৭১৭ এর ফারুকশিয়ারের ফরমান এবং পলাশির যুদ্ধের ষড়যন্ত্র সবেতেই সক্রিয় হাত ছিল আর্মেনিয়ানদের। আসুন এবার শুনি সেই অজানা ইতিহাস। 


সাল ১৬৯০, কলকাতার মাটিতে পা রাখলেন জব চারনক, উদ্দেশ্য দেশের পূর্ব অংশে কম্পানির ব্যবসার বিস্তার লাভ। কিন্তু প্রথম থেকেই বাধা। অনেক আগেথকেই এখানে ব্যবসা করছে পর্তুগীজরা। সেই সাথে দিল্লির নবাবের অনুমতি নেই এখানে ব্যবসা করার। অনুমতি যদিও পাওয়া যায় মুল সমস্যা হবে ব্যবসসার জন্য দুর্গ, ফ্যাক্টরি, গুদাম তৈরি করতে। তখন আবার বাংলার মসনদে বসে আছেন তিব্র ইংরেজ বিরিধী জবরদস্ত খাঁ। এই সব সমস্যার মধ্যে কেতে যায় প্রায় ৬ বছর। ১৬৯৬ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রহ শুরু করলেন শোভা সিং। ভাবা হল এই বিদ্রহ দমন করে হয়ত ইংরাজদের কিছু সাহায্য করবেন  জবরদস্ত খাঁ, কিন্তু তিনি ইংরেজ বিরোধিতা বজায় রাখলেন।
এখন উপায় না দেখে কোম্পানি এমন লোক খোঁজা শুরু করল যে জবরদস্ত খাঁ এর কাছে ইংরেজদের দাবি পেশ করতে পারবে। পাওয়াও গেল একজন আর্মেনিয়ান ব্যক্তি নাম খোজা ইসরায়েল সারহেদ যিনি হুগলী- এর একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী এবং গুজরাতের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ফানুস কালান্দারের ভাতুস্পুত্র। এবং সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হল আর্মেনিয়ানরা ইউরোপ থেকে স্থল পথে আফগানিস্থান এবং পারস্য হয়ে প্রথম ব্যবসা করতে আসে আকবরের সময়ে। সেই থেকে এই বংশের সাথে মুঘল বংশের সুসম্পর্ক আকবরের সময় থেকেই  ফলে মুঘল বাদশ-এর অনুমতি পাওয়া খুব কঠিন হবেনা। এরই মাঝে সাপে বর হল। ১৬৯৭ সালে ঔরঙ্গজেব-এর নাতি আজিম ওসমান এলেন বাংলার সুবেদার হয়ে। আনুমতি চাওয়া হল তার দরবারে যাওয়ার। অনুমতি এল। সারহেদ এর নেতৃত্বে কোম্পানির কর্মকর্তারা গেলেন সঙ্গে অনেক উপঢৌকন। কাজ হল ,আর্মেনিয়ানদের  মুঘল পরিবারে পরিচিতি কাজে আসল। অনুমতি পাওয়া গেল, চাইলে কোম্পানি কলিকাতা, সুতানুটি এবং গোবিন্দপুর কিনে নিতে পারবেন এবং নির্দিষ্ট বার্ষিক খাজনায় ব্যবসা এবং দুর্গ, ফ্যাক্টরি, গুদাম এবং জনবসতি সবই স্থাপন করতে পারবে। এই চুক্তির অপর ভিত্তি করে ১০ই নভেম্বর ১৬৯৮ সালে ১৩০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রিহয়ে গেল এই তিনটি গ্রাম এবং বার্ষিক খাজনা ঠিক হল ১১৯৫ টাকা। পত্তন হল কলকাতা নগরীর। এত কিছু কি হত যদি আর্মেনিয়ানরা না থাকত?


কিন্তু বিপদ পিছু ছাড়েনি ইংরেজদের। বাংলার নবাব জাফর খাঁ ক্রমাগত তাদের অধিকার খর্ব করতে থাকে। বাতিল করতে থাকে ইংরেজদের সমস্ত অধিকার। এবার উপায়? ঠিক হল দিল্লির সম্রাটের দরবারে আবেদন জানাতে হবে ব্যবসার জন্য। এখানেও সাহায্যে এগিয়ে আর্মেনিয়ান ব্যক্তি খোজা ইসরায়েল সারহেদ। তখন দিল্লির সিংহাসনে ফারুকশিয়ার আর এই খোজা ইসরায়েল সারহেদ তারই বাল্যবন্ধু। সেই সাথে খোজা ইসরায়েল সারহেদ এদেশীয় ভাষা জানেন ভাল করে ফলে সম্রাটকে দাবি জানাতে কোন অসুবিধাই হবেনা। কিন্তু ভয় একটাই যদি রাস্তায় বিপদ হয়। সে ব্যাবস্থাও হল, সেখানেও আর্মেনিয়ান সহায়। খোজা মানুর যিনি ঔরঙ্গজেবের দুহিতা বাদিসাহা বেগম এর অনুচর, তিনি খবর পাঠালেন যে পথে কোন বিপদের ভয় নেই।


এবার দূত বাহিনী গঠনের পালা, কোম্পানি প্রধান হিসাবে থাকলেন জন সারমান, মুল দাবি পেশকারী এবং দোভাষী হিসাবে থাকলেন খোজা ইসরায়েল সারহেদ এবং বাকি দুজন সদস্য হলেন জন প্রেট এবং এডওয়ার্ড স্টিফেন। অবশেষে ১৭১৭ সালে ফহারুক শিয়ার ফরমান জারি করলেন এবং ইংরেজদের অধিকার দিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বাণিজ্য এবং কুঠি তৈরি করার। সেই সাথে হুগলী নদীর দুপাশে ১০মাইল অবধি ৩৮টি গ্রাম কেনার অধিকার পায়। যার ফলে প্রায় পুরো ২৪ পরগনা ইংরেজদের হাতে থাকে। এবং একটি হুকুম নামার মাধ্যমে সম্রাট সকল সুবেদার এবং নবাব কে এই ফরমান মানার আদেশ দেন।


হাফ ছেড়ে বাঁচে কলকাতা বাসি কারন মুঘল আমলের কোন পরাধীনতাই আর নেই এই ইংরেজ রাজত্বে। ফলে ইংরাজদের সাথে ব্যবসা করে ক্রমেই ধনবান হতে থাকে বাংলার বনিক বাহিনী। কিন্তু সেই সময়ে এই দূত বাহিনীকেই কোন মূল্য দেইনি ব্রিটেন। তার বদলে সম্পূর্ণ সাফল্যের অধিকারী করা হয় ডা. হ্যামিল্টনকে , এবং দাবি করাহয় তিনি মুঘল সম্রাটের অসুখ নিরাময় করেছিলেন বলে এই ফরমান কোম্পানি পায়। সেন্ট জন চার্চে হামিল্টনের সমাধিতে আজও এই কথা লেখা আছে।  


এরপর আর কোন সমস্যাই হইনি। বাংলার নবাব-সুবেদারদের সাথে দরবার করে সব সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছিলেন খোজা ইসরায়েল সারহেদ। ইংরেজদেরও ব্যবসা ঝরের গতিতে এগচ্ছে, বাসস্থান, দুর্গ সব তৈরি হয়েছে, একাধিক বাঙালি ব্যবসায়ী ক্রমেই ধনী হয়ে উঠছেন, জনবসতি বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু কথায় আছে সুখ বেশীদিন থাকেনা জীবনে। ফরমানের চার দশকের মথায় ১৭৫৬ সালের জুন মাস, কোম্পানির ব্যবসা মধ্য গগনে সেই সাথে ঠাণ্ডার দেশের ইংরেজ কলকাতার ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল। এরই মধ্যে ১৬ই জুন ১৭৫৬ সিরাজউদ্দৌল্লা আক্রমন করলেন কলকাতায়। ইংরাজদের শোচনীয় পরাজয় ঘটলো, সিরাজউদ্দৌল্লা গুড়িয়ে দিলেন ইংরেজদের দুর্গ এবং ঘটলো অতি বিতর্কিত সেই অন্ধকূপ হত্যা। এবং কলকাতার নাম বদলে হল আলিনগর।


এই ঘটনা থেকে সহজে উদ্ধারের আশা নেই কারন সেই সময়ের কলকাতায় থাকা কোম্পানি প্রেসিডেন্ট ড্রেক এবং অন্যান্য কর্তারা কলকাতা আক্রমনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে টকা পয়সা এবং কাগজপত্র নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে নিজেদের প্রান বাঁচাতে। ফলে যে কয়েকজন ইংরেজ যুদ্ধের পর বেঁচে ছিলন তাদের ঠিকানা হল ফলতার ইংরেজ রিফিউজি কেন্দ্রতে। সেখানেও খাবার পৌঁছানোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করলান নবাবা।


ঠিক এই সময়েও পাশে এসে দাঁড়ালেন কলকাতার এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ী খোজা পোট্রাস আরাটন। রাতের অন্ধকারে খাবার পৌঁছতে শুরু করলেন ইংরেজদের কাছে। কারন কোন উপায় আর খলা নেই। ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তখন জাহাজে ফলে কোন মূল্যবান সিধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই পোট্রাস ক্লাইভ এর পথ কিছুটা সহজ করে রেখেছিলেন কলকাতার দায়িত্বে থাকা নবাবের কর্মচারী মানিকচাঁদের সাথে এবং তার মারফত উমিচাঁদ এবং জগত শেঠ এর সাথে। এইভাবে কয়েকমাস চলার পরে কলকাতায় এসে পৌঁছলেন ক্লাইভ এবং ওয়াটসন, আর শুরু হল মীরজাফরের সিরাজকে সরাবার ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের ফল সকলের জানা। এর পরে মীরজাফরকে সিনহাসনচুত করা এবং সেইসাথে বক্সারের যুদ্ধে মিরকাশিমকে হারানো সবেতেই মাথার অপর ছাতা হয়েছিল আর্মেনিয়ান এবং  খোজা পোট্রাস আরাটন।


কিন্তু ঐযে আগেই বলেছি ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর যখন ভারতে ইংরেজদের পাকাপাকি শাসন তখনি আর্মেনিয়ান দের বিরোধিতা শুরু করল ইংরেজ কোম্পানি। পোট্রাস কে মিথ্যে মালায় ফাঁসিয়ে শাস্তির দরবার শুরু হয়। মনের দুঃখে পোট্রাস চিঠি লিখলেন কম্পনির ইংল্যান্ড হউসে, সেই চিঠিতে তিনি লিখলেন “আপনাদের বিপদের সময়ে আমি নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশান্তরে ছুটে বেড়িয়েছি এবং সর্বোপরি আপনদের বর্তমান সুখকর পরিস্থিতির জন্য আমিই দায়ি কিন্তু আমার এমনি কপাল যে আপনারা একবারও আমার কথা উল্লেখ করলেন না। ”  সেই চিঠির কোন উত্তর আজও আসেনি এবং যানাও যায়নি শেষ অবধি পোট্রাসের কি হয়েছিল।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক আর্মেনীয় গবেষক লন্ডনের এক অন্ধকার ঘর থেকে অতি অজত্নে পড়েথাকা পোট্রাসের এই চিঠিটি উদ্ধার করেন তাও প্রায় দুই শতাব্দি পরে।



ইতিহাস সত্যিই নিষ্ঠুর।। 


তথ্য সুত্রঃ http://kolkatacitytours.com/armenian-church-kolkata/"আজব নগরী" - শ্রীপান্থ , কিশলয় প্রকাশনা।
"কলকাতা"- শ্রীপান্থ, আনন্দ পাবলিকেশন।
"কলকাতা"- আতুল সুর, সাহিত্যলোক।
"পুরনো কলকাতার কথাচিত্র"- পূর্ণেন্দু পাত্রী, দে'জ পাবলিশিং।
"কলকাতার ইতিহাস"- রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেববাহাদুর, জে এন চক্রবর্তী অ্যান্ড কোং।