ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতবর্গ এবং তাদের অমর কীর্তি।
১৮০০
খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়। এই কলজে
সংস্কৃত এবং প্রাচ্য সাহিত্য এবং সভতার ইতিহাস পড়ানোর জন্য ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের ৪
মে তারিখে বিভিন্ন বিভাগের জন্য একদল পণ্ডিত নিযুক্ত করাহয়। প্রধান পণ্ডিত হিসাবে
নিযুক্ত করাহয় পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকে এবং দ্বিতীয় পণ্ডিত হিসাবে
নিযুক্ত করাহয় রমানাথ বিদ্যাবাচস্পতিকে।
এছাড়া সহকারী পণ্ডিতরা ছিলেন- শ্রীপতি মুখোপাধ্যায়, আনন্দচন্দ্র, রাজীবলোচন
মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ মুখোপাধ্যায়, পদ্মলোচন চূড়ামণি এবং রামরাম বসু।
এর পরবর্তী কালে
যারা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন তারা হলেন- তারিণীচড়ণ মিত্র,
চন্ডীচরন মুন্সী, রামকিশোর তরকচূড়ামনি এবং কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন প্রমুখ।
দেশীয়
পণ্ডিতবর্গকে পুস্তক রচনায় উৎসাহ প্রদান করার জন্য কলেজ কতৃপক্ষ পুরষ্কার ঘোষণা
করেন। কতৃপক্ষের এই উৎসাহের ফলে আমরা যেসব বই লাভ করেছি তা হল-
রামরাম
বসু----‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’-----১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ
রামরাম
বসু----‘লিপিমালা’------১৮০২ খ্রিষ্টাব্দ
মৃত্যুঞ্জয়
বিদ্যালঙ্কার-----‘বত্রিশ সিংহাসন’-----১৮০২ খ্রিষ্টাব্দ
মৃত্যুঞ্জয়
বিদ্যালঙ্কার-----‘প্রবধচন্দ্রিকা’-----১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দ
চন্ডীচরন
মিত্র------‘ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট’----১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ
চন্ডীচরন
মুন্সী-----‘তেতো ইতিহাস’------১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ
রাজীবলোচন
মুখোপাধ্যায়--‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রয়াস্য চরিত্রং’--১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ
রামকিশোর
তর্কচুড়ামনি---‘হিতোপদেশ’----১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দ
রামমোহন প্রসাদ
ঠাকুর---‘ইংরাজি বাংলা শব্দকোষ’—১৮১০ খ্রিষ্টাব্দ
রামমোহন প্রসাদ
ঠাকুর---‘ইংরাজি ওড়িয়া অভিধান’—১৮১১ খ্রিষ্টাব্দ
হরপ্রসাদ
রায়----‘পুরুষপরীক্ষা’-------১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ
কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন----‘পদার্থ
কৌমুদি’---১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ
কাশীনাথ
তর্কপঞ্চানন----‘পাষণ্ডপীড়ন’---১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দ
কাশীনাথ
তর্কপঞ্চানন----‘সাধুসন্তষিনী’---১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দ
কাশীনাথ
তর্কপঞ্চানন----‘শ্যামাসন্তোষণ’---১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ
যাদের কথা এতক্ষণ
বললাম তারা সকলেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কলেজের সাথে
যুক্ত না থেকেও কলেজ কতৃপক্ষ গোলোকনাথ শর্মা(মুখোপাধ্যায়)এর রচিত ‘হিতোপদেশ’(১৮০২)
ছাপাতে উৎসাহী হয়। এছাড়া চন্ডীচরন মুন্সী কতৃক ভাগবদগীতা’র বঙ্গানুবাদ করা হলেও তা
ছাপানো হয়নি। আজ সেই পাণ্ডুলিপি রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরীতে রাখা আছে।
এইসময়ের সবথেকে
বড় পণ্ডিত ছিলেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের ভ্রাতুষ্পুত্র গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার যিনি
কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির সম্ভ রূপে কাজ করে গেছেন।জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ১৮০৫ থেকে
১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শ্রীরামপুর মিশনে চাকরি করেছেন এবং সমাচার দর্পণের
সম্পাদকীয় বিভাগের কর্ণধার। পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেন এবং
সর্বোপরি তার পরিচয় হল তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শিক্ষাগুরু।
সংস্কৃত কলেজ
প্রতিষ্ঠা এবং পণ্ডিতদের ভূমিকা।
১৮২৪
খ্রিষ্টাব্দে ‘সংস্কৃত গভঃ কলেজ’ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর যারা অধ্যাপনা করতেন তাদের
নামের তালিকা
স্মৃতি শাস্ত্রের
অধ্যাপক ছিলেন রামচন্দ্র বিদ্যালঙ্কার(স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রপিতামহ)।
১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারাগেলে তার স্থলাভিষিক্ত হন কাশিনাথ তরকপঞ্চানন।
ন্যায়শাস্ত্রের
অধ্যাপক ছিলেন বিখ্যাত নৈয়ায়িক নিমাইচন্দ্র শিরোমণি।
সাহিত্যের
অধ্যাপক ছিলেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার।
ব্যাকরণের অধ্যাপক
ছিলেন হরিপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন এবং কীর্তিচন্দ্র ন্যায়রত্ন এবং ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে
যোগদান করেন গঙ্গাধর তর্কবাগীশ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২৯ সালে সংস্কৃত কলেজে
ছাত্র হিসাবে যোগদান করে তিনি গঙ্গাধর তর্কবাগীশের কাছে ব্যাকরণ অধ্যায়ন করেন।
বেদান্ত শ্রেনির
অধ্যাপক ছিলেন কৃষ্ণদেব উপাধ্যায়। তার মৃত্যুর পর ২৯শে এপ্রিল ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে
শম্ভুনাথ বাচস্পতি এই বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।
অলঙ্কার শ্রেনির
অধ্যাপক ছিলেন কমলাকান্ত বিদ্যালঙ্কার। তার পদত্যাগের পর ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই
মাসে নিযুক্ত হন নাথুরাম শাস্ত্রী নামে একজন গুজরাটি পণ্ডিত।
এছাড়া যত সময়
এগিয়েছে আরও বিখ্যাত পণ্ডিত এই সংস্কৃত কলেজের সাথে যুক্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে
অন্যতম আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মধুসূদন গুপ্ত যিনি এদেশে প্রথম শব ব্যাবচ্ছেদ
করেছিলেন।
সংস্কৃত কলেজ
প্রতিষ্ঠা হলেও চতুষ্পদী গুলিতে অধ্যাপনার কাজ চলছিল পুরদমে। সেইসময় চতুষ্পদী
চালান ছাড়াও ব্রাহ্মন পণ্ডিতদের কাজ ছিল ‘পাতি’ দেওয়া বা সামাজিক কোন কাজে
বিশৃঙ্খলা দেখাদিলে বিধান দেওয়া। উনবিংশ শতাব্দীর সবথেকে বড় সঙ্কট দেখা দিল রানি
রাসমনি কতৃক দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে। কলকাতার ব্রাহ্মণ
সমাজ বিধান দিলেন যে কোন শুদ্রানির অধিকার নেই দেবতাকে ভোগ প্রদান করার। এই সময়
ত্রাতা হয়ে এলেন ঝামাপুকুর চতুষ্পদীর রামকুমার ভাট্টাচার্য। তিনি বললেন যে যদি
মন্দিরের সব সম্পত্তি কোন ব্রাহ্মণকে দান করেন তবে অন্ন ভোগ প্রদান করেত পারবেন।
এই কথামত তিনি দক্ষিণেশ্বরযাবতীয় সম্পত্তি রানি তাঁর গুরুদেবকে দান করে দেন।
কিন্তু তাঁর গুরুদেবের কেউই পুজা আর্চা করেননা। এইক্ষত্রেও রানিকে বিপদ থেকে রাক্ষা
করলেন রামকুমার ভাট্টাচার্য। তিনিই পূজকরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।
উনবিংশ শতাব্দীর
শেষের দিকের কিছু বিখ্যাত পণ্ডিতবর্গঃ
এই সময়ের কিছু
বিখ্যাত পণ্ডিত হলেন- হরিনাথ তর্কসিধান্ত(১৮২৯-১৮৮৯), মেহেশচন্দ্র
ন্যায়রত্ন(১৮৩৭-১৯০৭), জীবনানন্দ বিদ্যাসাগার(১৮৪৪-১৯১০), সত্যব্রত
সমাধ্যায়ী(১৮৪৬-১৯১১) এবং হরিনাথ সিদ্ধান্তবাগীশ(১৮৭১-১৯৬১)।
হরিনাথ
তর্কসিধান্ত ছিলেন গৌড়ীয় নব্যন্যায়ের “নির্বাণোন্মুখ উজ্জ্বলতার শেষ স্ফূর্তি”।
তিনি মুলাজড়ের বিখ্যাত সংস্কৃত বিদ্যালয়ের ন্যায়ের অধ্যাপক রূপে কাজ শুরুকরার
কিছুদিনের মধ্যে নৈন্যায়িক হিসাবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে।
মহামহোপাধ্যায়
মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন কলকাতার সংস্কৃত কলজে প্রথমে অলঙ্কার শাস্ত্রের অধ্যাপক
হিসাবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
হাওড়া থেকে আমতা রেললাইন তারই প্রচেষ্টায় তৈরি হয়। ইংরাজ সরকার তাকে সি.আই.ই উপাধি
দিয়েছিলেন। কলকাতায় আজও তাঁর নামে একটি রাস্তা আছে, নাম ‘ন্যায়রত্ন লেন’।
জীবনানন্দ
বিদ্যাসাগর ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন এবং বিদ্যাসাগার
উপাধি লাভ করেন। তিনি নিজ প্রচেষ্টায় টীকাসহ ১০৭টি এবং টীকাহীন ১০৮টি মূল্যবান
সংস্কৃত গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।
সত্যব্রত
সমাধ্যায়ী সেযুগের একজন প্রসিদ্ধ বৈদিক পণ্ডিত এবং বেদ প্রচারক ছিলেন। বুন্দিরাজ
তাঁর বেদ-পারঙ্গমতায় চমৎকৃত হয়ে ‘সামশ্রমী’ উপাধি দেন। তিনি সামবেদ এবং অন্যান্য
অনেক গ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
মহাভারতের
সারানুবাদ সম্পাদনা করে হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য প্রকাশ করেন
এবং ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি লাভ করেন।
আজকের ইতিহাস বলা
এখানেই শেষ করলাম। খুব তাড়াতাড়ি আবার শোনাব কলকাতার কোনোএক নতুন ইতিহাস।
-----------------------------------------------
X -------------------------------------
কিছু ভুল রয়েছে
ReplyDeleteTHAKTE PARE APNI JODI VULGULI POINTOUT KORE DEN TAHOLE AMI THIK KORE DITE PARI
Delete